জিআই ট্যাগ কী? গোবিন্দভোগ চালের মতো পণ্যে কৃষকদের জন্য উচ্চ মূল্যের সুযোগ

ভারতের কৃষি খাতে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই ট্যাগ (Geographical Indication Tag) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জিআই ট্যাগ (GI Tag benefits) এমন একটি বৌদ্ধিক সম্পত্তির…

Boosting Farmers’ Income with Gobindobhog Rice

ভারতের কৃষি খাতে ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই ট্যাগ (Geographical Indication Tag) একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। জিআই ট্যাগ (GI Tag benefits) এমন একটি বৌদ্ধিক সম্পত্তির অধিকার, যা কোনও নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কিত পণ্যের গুণমান, খ্যাতি এবং স্বতন্ত্রতা সুরক্ষিত করে। পশ্চিমবঙ্গের গোবিন্দভোগ চাল, দার্জিলিং চা, বা মধ্যপ্রদেশের কাদাকনাথ মুরগির মতো পণ্যগুলো জিআই ট্যাগের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ট্যাগ কৃষকদের তাদের পণ্যের জন্য উচ্চ মূল্য নিশ্চিত করতে এবং নকল পণ্যের হাত থেকে সুরক্ষা দিতে সহায়তা করে। ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৬০০টির বেশি পণ্য জিআই ট্যাগ পেয়েছে, যার মধ্যে ১৫০টির বেশি কৃষি ও খাদ্য পণ্য। এই নিবন্ধে আমরা জিআই ট্যাগের গুরুত্ব, এর সুবিধা এবং কৃষকদের জন্য এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

জিআই ট্যাগ কী?
জিআই ট্যাগ হলো একটি বিশেষ স্বীকৃতি, যা কোনও পণ্যের উৎপত্তিস্থল এবং তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের গোবিন্দভোগ চাল তার সুগন্ধ, স্বাদ এবং টেক্সচারের জন্য বিখ্যাত, যা এই অঞ্চলের মাটি, জলবায়ু এবং চাষ পদ্ধতির ফল। জিআই ট্যাগ এই চালকে অন্যান্য সাধারণ চাল থেকে আলাদা করে এবং এর বাজার মূল্য বাড়ায়। ভারতের জিআই আইন, ১৯৯৯ (The Geographical Indications of Goods Act, 1999) এই ট্যাগ প্রদানের নিয়ম নির্ধারণ করে। এই ট্যাগ পাওয়ার পর কোনও পণ্যকে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপাদিত হলেই সেই নামে বিক্রি করা যায়, যা নকল পণ্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেয়।

   

কৃষকদের জন্য জিআই ট্যাগের সুবিধা
১. উচ্চ মূল্য নিশ্চিতকরণ: জিআই ট্যাগযুক্ত পণ্যের বাজার মূল্য সাধারণ পণ্যের তুলনায় বেশি। উদাহরণস্বরূপ, গোবিন্দভোগ চালের দাম প্রতি কেজি ১০০-১৫০ টাকা, যেখানে সাধারণ চালের দাম ৪০-৬০ টাকা। জিআই ট্যাগ এই চালের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে কৃষকদের লাভ বাড়ায়।
২. বাজার স্বীকৃতি: জিআই ট্যাগ পণ্যের গুণমান ও খ্যাতি বাড়ায়, যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করে। দার্জিলিং চা, যা জিআই ট্যাগ পেয়েছে, বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি ১০০০-৫০০০ টাকায় বিক্রি হয়। এটি চা চাষিদের আয় বাড়িয়েছে।
৩. নকলের বিরুদ্ধে সুরক্ষা: জিআই ট্যাগ নিশ্চিত করে যে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট অঞ্চলের উৎপাদকরা পণ্যের নাম ব্যবহার করতে পারেন। এটি কৃষকদের বাজারে প্রতারণা থেকে রক্ষা করে।
৪. গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নতি: জিআই ট্যাগ স্থানীয় কৃষক সম্প্রদায়ের আয় বাড়ায় এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া ও বর্ধমান জেলায় গোবিন্দভোগ চাষে জড়িত হাজার হাজার কৃষক এই ট্যাগের সুবিধা পাচ্ছেন।

গোবিন্দভোগ চাল: একটি উদাহরণ
পশ্চিমবঙ্গের গোবিন্দভোগ চাল ২০১৭ সালে জিআই ট্যাগ পেয়েছে। এই সুগন্ধি চাল, যা প্রধানত নদিয়া, বর্ধমান, এবং বীরভূম জেলায় চাষ হয়, তার স্বতন্ত্র স্বাদ এবং গন্ধের জন্য বিখ্যাত। জিআই ট্যাগ পাওয়ার পর এই চালের চাহিদা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপে গোবিন্দভোগ চালের রপ্তানি বছরে ১০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি স্থানীয় কৃষকদের আয় প্রায় ৩০% বাড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, গোবিন্দভোগ চাষে জড়িত কৃষকরা এখন প্রতি হেক্টরে ৫০,০০০-৭০,০০০ টাকা অতিরিক্ত আয় করছেন।

জিআই ট্যাগের প্রক্রিয়া ও চ্যালেঞ্জ
জিআই ট্যাগ পাওয়ার জন্য কৃষক সম্প্রদায় বা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ভারতের জিআই রেজিস্ট্রি, চেন্নাইতে আবেদন করতে হয়। আবেদনে পণ্যের ভৌগোলিক উৎপত্তি, ঐতিহাসিক পটভূমি, এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ দিতে হয়। তবে, এই প্রক্রিয়া জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। অনেক কৃষক জিআই ট্যাগের সুবিধা সম্পর্কে অবগত নন। এছাড়া, ট্যাগ পাওয়ার পর পণ্যের গুণমান বজায় রাখা এবং বাজারজাতকরণের জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা একটি চ্যালেঞ্জ।

Advertisements

সরকার এই সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। কৃষি মন্ত্রণালয় এবং রাজ্য সরকারগুলো জিআই ট্যাগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে। পশ্চিমবঙ্গে, কৃষি বিপণন বোর্ড গোবিন্দভোগ চালের ব্র্যান্ডিং এবং রপ্তানির জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু করেছে। এছাড়া, অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপ যেমন নিনজাকার্ট এবং ডিহাট জিআই ট্যাগযুক্ত পণ্যের জন্য ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস তৈরি করছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
জিআই ট্যাগ ভারতের কৃষি খাতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি ভারতীয় পণ্যের বৈশ্বিক পরিচিতি বাড়াচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে, গোবিন্দভোগ ছাড়াও কালো নুনিয়া চাল, তুলাইপাঞ্জি চাল, এবং জয়নগরের মোয়ার মতো পণ্য জিআই ট্যাগ পেয়েছে। এই ট্যাগগুলো স্থানীয় কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে সহায়তা করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী পাঁচ বছরে জিআই ট্যাগযুক্ত পণ্যের রপ্তানি ২০% বৃদ্ধি পেতে পারে, যা ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে ১০০০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত অবদান রাখবে।

জিআই ট্যাগ কৃষকদের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা তাদের পণ্যের মূল্য বাড়ায় এবং বিশ্ববাজারে স্বীকৃতি দেয়। গোবিন্দভোগ চালের মতো পণ্য এই ট্যাগের মাধ্যমে কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি ভারতের সাংস্কৃতিক ও কৃষি ঐতিহ্যকে তুলে ধরছে। সরকারি সহায়তা, সচেতনতা, এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে জিআই ট্যাগ আরও বেশি কৃষকের কাছে পৌঁছালে, ভারতীয় কৃষি খাত বিশ্বমঞ্চে আরও শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলবে।