মাটি থেকে স্মার্টফোন! কীভাবে তরুণ কৃষকরা ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ করছেন?

কৃষি, যা একসময় হাতের লাঙল আর ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল ছিল, এখন ডিজিটাল বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। ভারতের তরুণ কৃষকরা এখন মাটির সঙ্গে স্মার্টফোনের সমন্বয় ঘটিয়ে…

How Young Farmers Are Embracing Digital Transformation

কৃষি, যা একসময় হাতের লাঙল আর ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল ছিল, এখন ডিজিটাল বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। ভারতের তরুণ কৃষকরা এখন মাটির সঙ্গে স্মার্টফোনের সমন্বয় ঘটিয়ে (Digital Transformation) কৃষিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT), এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁরা কৃষি উৎপাদন বাড়াচ্ছেন, খরচ কমাচ্ছেন এবং টেকসই চাষের পথ প্রশস্ত করছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা দেখব, কীভাবে তরুণ কৃষকরা ‘মাটি থেকে স্মার্টফোন’ যুগে প্রবেশ করছেন এবং কৃষি খাতে ডিজিটাল রূপান্তর ঘটাচ্ছেন।

তরুণ কৃষকদের ডিজিটাল যাত্রা
ভারতের কৃষি খাতে তরুণ প্রজন্মের প্রবেশ কৃষি পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার তরুণ কৃষক অরিন্দম মণ্ডল (নাম পরিবর্তিত) একজন উদাহরণ। তিনি তাঁর স্মার্টফোনে ‘কৃষিকার্ট’ অ্যাপ ব্যবহার করে ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করেন এবং মাটির পুষ্টিগুণ পরীক্ষা করেন। তিনি বলেন, “আগে আমরা আবহাওয়া বা মাটির অবস্থা সম্পর্কে অনুমান করতাম। এখন ড্রোন এবং সেন্সর আমাকে সঠিক তথ্য দেয়, যার ফলে আমি সঠিক সময়ে সেচ, সার, এবং কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারি।” অরিন্দমের মতো তরুণ কৃষকরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফলন বাড়াচ্ছেন এবং খরচ কমাচ্ছেন।

   

ইউটিউব এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তরুণ কৃষকরা কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে জানছেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘ডিজিটাল গ্রিন’ নামক একটি প্ল্যাটফর্ম ৫০টিরও বেশি ভাষায় কৃষি সংক্রান্ত ভিডিও তৈরি করে, যা তরুণ কৃষকদের ফসল ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই চাষ সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। এই ধরনের ই-এক্সটেনশন সার্ভিস তরুণ কৃষকদের জন্য সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী।

প্রযুক্তির ভূমিকা
ডিজিটাল কৃষির মূল উপাদান হল প্রিসিশন ফার্মিং। এটি জিপিএস-চালিত ট্র্যাক্টর, ড্রোন, এবং IoT সেন্সর ব্যবহার করে মাটির গুণমান, ফসলের স্বাস্থ্য, এবং আবহাওয়ার তথ্য সংগ্রহ করে। উদাহরণস্বরূপ, ড্রোনগুলো ৩ডি ইমেজিংয়ের মাধ্যমে মাটির গুণমান বিশ্লেষণ করে এবং বীজ বপনের পরিকল্পনা তৈরি করে। এটি জলের অপচয় কমায় এবং কীটনাশকের ব্যবহার ৫ গুণ দ্রুত করে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে তরুণ কৃষক সোহম দাস ড্রোন ব্যবহার করে তাঁর ধানের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটিয়েছেন, যা তাঁর সময় এবং খরচ দুই-ই বাঁচিয়েছে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং কৃষকদের ফসলের ফলন, বাজারের চাহিদা, এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ‘প্ল্যান্টিক্স’ নামক একটি অ্যাপ স্মার্টফোনের ছবির মাধ্যমে ফসলের রোগ, পোকামাকড়, এবং পুষ্টির ঘাটতি নির্ণয় করে। এই ধরনের অ্যাপ তরুণ কৃষকদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এছাড়া, IoT সেন্সর মাটির আর্দ্রতা, পিএইচ, এবং পুষ্টিগুণ পর্যবেক্ষণ করে, যা ফসলের জন্য সঠিক পরিমাণে জল এবং সার প্রয়োগে সহায়তা করে।

টেকসই কৃষি এবং পরিবেশগত সুবিধা
ডিজিটাল কৃষি টেকসই চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অতিরিক্ত সার এবং কীটনাশক ব্যবহার মাটির ক্ষতি এবং পরিবেশ দূষণের কারণ। তরুণ কৃষকরা ভেরিয়েবল রেট টেকনোলজি (VRT) ব্যবহার করে সঠিক পরিমাণে সার এবং জল প্রয়োগ করছেন, যা পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব কমায়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে VRT ব্যবহার করে ফলন ৯-১৩% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সারের ব্যবহার ৭% কমেছে। ভারতেও এই প্রযুক্তি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে।

তরুণ কৃষকরা ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং মাটির স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাবের তরুণ কৃষক রাহুল সিং স্মার্ট ইরিগেশন সিস্টেম ব্যবহার করে জলের অপচয় ৫০% কমিয়েছেন। এই ধরনের উদ্যোগ পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি খরচও কমায়।

Advertisements

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
ডিজিটাল কৃষির সুবিধা সত্ত্বেও, তরুণ কৃষকরা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির উচ্চ খরচ এবং গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের অভাব বড় বাধা। এছাড়া, অনেক কৃষকের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের দক্ষতার অভাব রয়েছে। তবে, তরুণ কৃষকরা এই সমস্যার সমাধান করছেন। তারা স্থানীয় সংগঠন এবং স্টার্টআপের সঙ্গে কাজ করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ক্রপিনের মতো অ্যাগ্রিটেক কোম্পানি সাশ্রয়ী মূল্যে সফটওয়্যার-অ্যাজ-এ-সার্ভিস (SaaS) প্রদান করে, যা তরুণ কৃষকদের জন্য সহজলভ্য।

ডেটা গোপনীয়তাও একটি বড় উদ্বেগ। কৃষকরা চিন্তিত যে তাঁদের ডেটা তৃতীয় পক্ষের হাতে যেতে পারে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো ডেটা গভর্ন্যান্স নীতি তৈরি করছে। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেটা অ্যাক্ট এবং কৃষি ডেটা শেয়ারিং কোড অফ কন্ডাক্ট কৃষকদের ডেটা সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। ভারতেও এই ধরনের নীতি প্রয়োজন।

তরুণ কৃষকদের ভূমিকা
তরুণ কৃষকরা শুধু প্রযুক্তি গ্রহণই করছেন না, তারা অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপ এবং উদ্যোক্তা হিসেবেও কাজ করছেন। উদাহরণস্বরূপ, তাকাচার নামক একটি ভারতীয় স্টার্টআপ কৃষি বর্জ্যকে জৈব জ্বালানি এবং সারে রূপান্তর করছে, যা তরুণ উদ্যোক্তা বিদ্যুৎ মোহনের উদ্যোগ। এই ধরনের উদ্যোগ কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে এবং তরুণদের কৃষির প্রতি আকৃষ্ট করছে।

সরকারি উদ্যোগও তরুণ কৃষকদের সাহায্য করছে। ভারতের ডিজিটাল এগ্রিকালচার মিশন তরুণ কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তি সরবরাহ করছে। এই উদ্যোগ তরুণদের মধ্যে ডিজিটাল দক্ষতা বাড়াচ্ছে এবং কৃষিকে লাভজনক পেশা হিসেবে গড়ে তুলছে।

তরুণ কৃষকরা মাটি থেকে স্মার্টফোনের যুগে প্রবেশ করে কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটাচ্ছেন। ড্রোন, AI, IoT, এবং ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁরা ফলন বাড়াচ্ছেন, খরচ কমাচ্ছেন, এবং টেকসই চাষের পথ প্রশস্ত করছেন। যদিও উচ্চ খরচ, ইন্টারনেট সংযোগের অভাব, এবং ডেটা গোপনীয়তার মতো চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তরুণ কৃষকরা এই বাধা অতিক্রম করছেন। সরকার, বেসরকারি সংস্থা, এবং অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপগুলোর সমর্থনে তাঁরা কৃষিকে আরও উন্নত এবং লাভজনক করে তুলছেন। এই ডিজিটাল বিপ্লব ভারতের কৃষি খাতকে খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তরুণ কৃষকরা পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছেন।