ভারতের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলেও, ছোট এবং ভাঙা জমির মালিকানার (Small Landholdings) কারণে কৃষকদের জন্য কৃষি ক্রমশ অলাভজনক হয়ে উঠছে। ২০১৫-১৬ সালের কৃষি শুমারি অনুযায়ী, ভারতের গড় কৃষি জমির আকার ১৯৭০-৭১ সালে ২.২৮ হেক্টর থেকে কমে ২০১৫-১৬ সালে মাত্র ১.০৮ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে কৃষি জমির সংখ্যা ৭১ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ১৪৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে। এই জমির ভাঙন, যা প্রধানত উত্তরাধিকার আইন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ঘটেছে, কৃষকদের আয় এবং কৃষির উৎপাদনশীলতার উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে গড় জমির আকার মাত্র ০.৭৭ হেক্টর, এই সমস্যা আরও তীব্র। এই নিবন্ধে আমরা ভারতের ছোট জমির মালিকানা এবং জমির ভাঙনের কারণে কৃষকদের সামনে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
জমির ভাঙনের কারণ
ভারতের কৃষি জমির ভাঙনের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে, যা কৃষকদের জন্য অলাভজনক পরিস্থিতি তৈরি করছে:
- উত্তরাধিকার আইন: ভারতের ঐতিহ্যবাহী উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, পৈতৃক সম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হয়। ফলস্বরূপ, প্রতি প্রজন্মে জমির আকার কমে যায়, যা কৃষি কার্যক্রমকে অলাভজনক করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ৫ একর জমি তিন পুত্রের মধ্যে ভাগ হলে প্রত্যেকে মাত্র ১.৬৭ একর পায়, যা আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি বা সেচ ব্যবস্থার জন্য অপর্যাপ্ত।
- জনসংখ্যা বৃদ্ধি: জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে একই জমি আরও বেশি মানুষের মধ্যে ভাগ হচ্ছে। ১৯৭০-৭১ থেকে ২০১০-১১ সালের মধ্যে কৃষি জমির সংখ্যা ১৯৪% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গ্রামীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির (১৮৯%) সঙ্গে প্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ।
- ভূমি বিক্রি ও শহরায়ন: শহরাঞ্চলের সম্প্রসারণের ফলে জমির দাম বেড়েছে, যার কারণে অনেক কৃষক তাদের জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। এছাড়াও, অবকাঠামো উন্নয়ন যেমন রাস্তা ও হাইওয়ে নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, যা কৃষি জমির পরিমাণ আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
- গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর: গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে স্থানান্তরের ফলে কৃষি জমি পরিত্যক্ত বা অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদনশীলতাকে আরও কমিয়ে দেয়।
ছোট জমির প্রভাব
ছোট এবং ভাঙা জমির কারণে কৃষকরা একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, যা কৃষিকে অলাভজনক করে তুলছে:
- যান্ত্রিকীকরণের অসুবিধা: আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি যেমন ট্রাক্টর, হার্ভেস্টার বা সেচ ব্যবস্থা বড় জমির জন্য ডিজাইন করা হয়। ছোট এবং ভাঙা জমিতে এই যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা অসম্ভব বা অলাভজনক। ফলে কৃষকরা ঐতিহ্যবাহী, কম দক্ষ পদ্ধতির উপর নির্ভর করেন।
- উচ্চ উৎপাদন খরচ: ছোট জমিতে বীজ, সার, এবং কীটনাশকের মতো উপকরণের দাম বড় জমির তুলনায় বেশি হয়, কারণ কৃষকরা বড় পরিমাণে ক্রয় করতে পারেন না। এটি উৎপাদন খরচ বাড়ায় এবং লাভের পরিমাণ কমায়।
- ফসলের বৈচিত্র্যের অভাব: বড় জমিতে ফসলের বৈচিত্র্য বজায় রাখা সম্ভব, যা মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং ফসলের ক্ষতির ঝুঁকি কমায়। কিন্তু ছোট জমিতে কৃষকরা একফসলী চাষের উপর নির্ভর করেন, যা মাটির গুণমান নষ্ট করে এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে।
- বাজারে সীমিত প্রবেশাধিকার: ছোট কৃষকরা প্রায়শই মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে তাদের ফসল বিক্রি করেন, যারা মুনাফার একটি বড় অংশ নিয়ে নেন। এছাড়াও, বাজার মূল্যের অস্থিরতা তাদের আয়ের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
- ঋণের বোঝা: জাতীয় নমুনা জরিপ (এনএসএস) ২০১৮-১৯ অনুযায়ী, ৫০% এরও বেশি কৃষি পরিবার ঋণের মধ্যে রয়েছে, যার গড় পরিমাণ প্রায় ৭৫,০০০ টাকা। ছোট কৃষকরা প্রায়শই উচ্চ সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নেন, যা তাদের ঋণের জালে আটকে ফেলে।
পশ্চিমবঙ্গে জমির ভাঙন
পশ্চিমবঙ্গে জমির ভাঙনের সমস্যা বিশেষভাবে তীব্র। ২০১০-১১ সালের কৃষি শুমারি অনুযায়ী, রাজ্যের গড় জমির আকার মাত্র ০.৭৭ হেক্টর, যা জাতীয় গড় (১.১৬ হেক্টর) থেকে অনেক কম। নদিয়া জেলার চাকদহ ব্লকের রাউতারি গ্রামে ২০১৬-১৭ সালে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৪১টি ছোট-মাঝারি কৃষি পরিবারের জমি অত্যন্ত ভাঙা এবং ঐতিহ্যবাহী পুরুষতান্ত্রিক মালিকানা ব্যবস্থার কারণে মহিলারা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই অঞ্চলে জমির ভাঙন ফসলের উৎপাদনশীলতা এবং কৃষকদের আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
সমাধানের পথ
জমির ভাঙন এবং ছোট জমির মালিকানার সমস্যা সমাধানের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
- সমবায় চাষ: ছোট কৃষকরা সমবায় গঠন করে সম্পদ, যন্ত্রপাতি এবং বাজারে প্রবেশাধিকার ভাগ করে নিতে পারেন। এটি উৎপাদন খরচ কমাতে এবং লাভ বাড়াতে সাহায্য করবে।
- জমি একত্রীকরণ: স্বেচ্ছায় জমি একত্রীকরণের নীতি কৃষকদের বড় এবং আরও লাভজনক জমির প্লট তৈরি করতে উৎসাহিত করতে পারে। তবে, সঠিক ভূমি রেকর্ড বজায় রাখা এই প্রক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য।
- আধুনিক প্রযুক্তির প্রবর্তন: হাইড্রোপনিক্স এবং নির্ভুল কৃষির মতো প্রযুক্তি ছোট জমিতেও উচ্চ ফলন নিশ্চিত করতে পারে। সরকার এবং কৃষি-প্রযুক্তি স্টার্টআপগুলি এই প্রযুক্তির প্রচলন বাড়াতে পারে।
- ঋণ এবং বাজারে প্রবেশাধিকার: কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ এবং সরাসরি বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কৃষক উৎপাদক সংগঠন (এফপিও) এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
- মহিলাদের জমির অধিকার: পশ্চিমবঙ্গের মতো অঞ্চলে মহিলাদের জমির মালিকানা অধিকার নিশ্চিত করা কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে, কারণ মহিলারা কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারতের ছোট এবং ভাঙা জমির মালিকানা কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে, যা কৃষিকে অলাভজনক করে তুলছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে এই সমস্যা আরও তীব্র। জমির ভাঙনের ফলে কৃষকরা আধুনিক প্রযুক্তি, বাজারে প্রবেশাধিকার এবং পর্যাপ্ত আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সরকার, কৃষি-প্রযুক্তি সংস্থা এবং সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমবায় চাষ, জমি একত্রীকরণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এই পদক্ষেপগুলি কৃষকদের আয় বাড়াতে এবং কৃষিকে টেকসই করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।