পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে একীভূত কৃষি পদ্ধতি (Integrated Farming Systems) একটি নতুন বিপ্লব নিয়ে এসেছে। এই পদ্ধতিতে একই খামারে মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন এবং ফসল উৎপাদনের সমন্বয় ঘটিয়ে কৃষকরা তাদের আয় বাড়াচ্ছেন এবং টেকসই কৃষি চর্চার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। একীভূত কৃষি শুধুমাত্র লাভ বাড়ায় না, বরং জল, জমি এবং সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং বর্জ্য হ্রাস করে। পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া, হুগলি, এবং পূর্ব মেদিনীপুরের মতো জেলাগুলিতে এই পদ্ধতি কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই প্রতিবেদনে আমরা দেখব কীভাবে একীভূত কৃষি পদ্ধতি পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য লাভজনক হয়ে উঠছে এবং এর সুবিধাগুলি কী কী।
একীভূত কৃষি পদ্ধতি কী?
একীভূত কৃষি পদ্ধতি হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে বিভিন্ন কৃষি কার্যক্রম যেমন ফসল চাষ, মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন, এবং গবাদি পশু পালন একই খামারে সমন্বিতভাবে পরিচালিত হয়। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হলো একটি উপাদানের বর্জ্যকে অন্য উপাদানের সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করা। উদাহরণস্বরূপ, হাঁস-মুরগির বর্জ্য মাছ চাষের পুকুরে সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদন বাড়ায় এবং মাছের খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা কমায়। একইভাবে, পুকুরের জল সেচের জন্য ফসলের ক্ষেতে ব্যবহার করা যায়, যা জলর ব্যবহার কমায়।
পশ্চিমবঙ্গে একীভূত কৃষির সাফল্য
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা, বিশেষ করে হাওড়া এবং পূর্ব মেদিনীপুরের কৃষকরা, এই পদ্ধতির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করছেন। উদাহরণস্বরূপ, হাওড়ার কৃষক রমেশ মণ্ডল তাঁর ২ একর জমিতে মাছ চাষ, ধান চাষ এবং হাঁস পালনের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। তিনি পুকুরে কাতলা এবং রুই মাছ চাষ করেন, পুকুরের পাশে হাঁসের খামার স্থাপন করেছেন এবং পুকুরের জল দিয়ে ধানের ক্ষেতে সেচ দেন। তাঁর মতে, এই পদ্ধতিতে তিনি প্রতি বছর প্রায় ৩-৪ লক্ষ টাকা লাভ করছেন, যেখানে ঐতিহ্যবাহী ধান চাষে তাঁর লাভ ছিল মাত্র ১ লক্ষ টাকা।
হুগলির কৃষক সুজিত মাইতি তাঁর খামারে মাছ, মুরগি এবং শাকসবজি চাষ করছেন। তিনি মুরগির বর্জ্য দিয়ে পুকুরে মাছের খাদ্য তৈরি করেন এবং পুকুরের জল দিয়ে পালং শাক এবং ফুলকপি চাষ করেন। এই পদ্ধতিতে তাঁর খরচ প্রায় ৪০% কমেছে এবং আয় দ্বিগুণ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের একীভূত কৃষি পদ্ধতি কৃষকদের জন্য ‘শূন্য বর্জ্য’ মডেল হিসেবে কাজ করছে, যা পরিবেশবান্ধব এবং লাভজনক।
একীভূত কৃষির সুবিধা
১. উচ্চ লাভ: একীভূত কৃষিতে একাধিক উৎস থেকে আয় আসে। মাছ, হাঁস-মুরগি, এবং ফসল বিক্রি করে কৃষকরা তাদের আয় বাড়াতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, একটি ১ একর খামারে মাছ চাষ থেকে বছরে ২ লক্ষ, হাঁস পালন থেকে ১ লক্ষ, এবং ফসল থেকে ১-২ লক্ষ টাকা আয় সম্ভব।
২. শূন্য বর্জ্য: এই পদ্ধতিতে একটি উপাদানের বর্জ্য অন্য উপাদানের জন্য সম্পদ হিসেবে কাজ করে। মাছের পুকুরের জল ফসলের জন্য সার এবং সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়।
৩. জল ও সম্পদ সাশ্রয়: ঐতিহ্যবাহী কৃষির তুলনায় এই পদ্ধতিতে ৩০-৫০% জল কম ব্যবহৃত হয়। পুকুরের জল পুনঃব্যবহারের মাধ্যমে সেচের খরচ কমানো সম্ভব।
৪. টেকসই কৃষি: এই পদ্ধতি পরিবেশবান্ধব, কারণ এটি রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার কমায় এবং জৈব সারের উপর নির্ভর করে।
৫. ঝুঁকি হ্রাস: একাধিক ফসল এবং কার্যক্রমের সমন্বয় থাকায় একটি উপাদানে ক্ষতি হলেও অন্য উপাদান থেকে আয়ের নিশ্চয়তা থাকে।
পশ্চিমবঙ্গে একীভূত কৃষির সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক সম্পদ এই পদ্ধতির জন্য আদর্শ। রাজ্যের প্রচুর পুকুর, নদী এবং উর্বর জমি মাছ চাষ এবং ফসল উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মৎস্য ও পশুপালন বিভাগ এই পদ্ধতির প্রচারে ভর্তুকি এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। উদাহরণস্বরূপ, মৎস্য বিভাগ প্রতি হেক্টরে মাছ চাষের জন্য ৪০% ভর্তুকি প্রদান করে, এবং হাঁস-মুরগি পালনের জন্য ২৫% ভর্তুকি দেওয়া হয়।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি গবেষণা কেন্দ্রগুলি, যেমন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করছে। এই কর্মশালাগুলিতে কৃষকরা মাছ চাষের জন্য প্ল্যাঙ্কটন ব্যবস্থাপনা, হাঁস-মুরগির রোগ প্রতিরোধ, এবং ফসলের জৈব চাষ সম্পর্কে শিখছেন। এছাড়া, স্থানীয় বাজারে মাছ, হাঁস-মুরগি, এবং শাকসবজির উচ্চ চাহিদা কৃষকদের জন্য এই পদ্ধতিকে আরও লাভজনক করে তুলছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
একীভূত কৃষি পদ্ধতির প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ হলো উচ্চ প্রাথমিক বিনিয়োগ। একটি ১ একর খামারে মাছ চাষ, হাঁস-মুরগি পালন এবং ফসল চাষের জন্য ২-৩ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে, সরকারি ভর্তুকি এবং কম খরচে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে এই খরচ কমানো সম্ভব। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের মধ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব একটি বড় সমস্যা। এটি মোকাবিলায় স্থানীয় কৃষি বিভাগ এবং ইউটিউব চ্যানেল যেমন অ্যাগ্রিকালচার ডায়েরি বা ফার্মিং লিডার থেকে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। তৃতীয়ত, বাজার সংযোগের অভাব থাকলে কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান না। এই সমস্যা সমাধানে কৃষক সমবায় সমিতি এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
একীভূত কৃষি পদ্ধতি পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক এবং টেকসই সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মাছ, হাঁস-মুরগি এবং ফসলের সমন্বয়ে কৃষকরা তাদের আয় বাড়াচ্ছেন এবং পরিবেশের উপর নির্ভরতা কমাচ্ছেন। সরকারি সহায়তা, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ এবং বাজারের চাহিদার কারণে এই পদ্ধতি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা যদি এই পদ্ধতি গ্রহণ করেন, তবে তারা কেবল আর্থিকভাবে লাভবান হবেন না, বরং রাজ্যের কৃষি খাতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবেন।