সারের সংকট? ঘরে তৈরি করুন প্রাকৃতিক সার

বর্তমান সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের সংকট একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষি-নির্ভর রাজ্যে, যেখানে কৃষকরা ফসল উৎপাদনের জন্য সারের উপর…

Fertilizer Shortage? Discover How to Make Organic Fertilizers at Home for Sustainable Farming

বর্তমান সময়ে কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সারের সংকট একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষি-নির্ভর রাজ্যে, যেখানে কৃষকরা ফসল উৎপাদনের জন্য সারের উপর নির্ভর করে, সেখানে এই সংকট ফসলের গুণগত মান এবং উৎপাদনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তবে, এই সমস্যার সমাধান হিসেবে জৈব সার (Organic Fertilizers) তৈরি এবং কম্পোস্টের ব্যবহার কৃষকদের জন্য একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব বিকল্প হতে পারে। এই প্রতিবেদনে আমরা ঘরে তৈরি প্রাকৃতিক সার এবং কম্পোস্ট ব্যবহারের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব, যা কৃষক এবং বাড়ির বাগানকারীদের জন্য উপকারী হবে।

জৈব সার তৈরির প্রয়োজনীয়তা
রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং পরিবেশের ক্ষতি করে। এর বিপরীতে, জৈব সার মাটির গঠন উন্নত করে, উপকারী অণুজীবের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং ফসলের পুষ্টিগুণ বজায় রাখে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা, যারা ধান, গম, শাকসবজি এবং ফলের চাষের সাথে জড়িত, তারা ঘরে তৈরি জৈব সার ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমাতে পারেন এবং ফসলের গুণমান বাড়াতে পারেন।

   

ঘরে জৈব সার তৈরির সহজ পদ্ধতি
জৈব সার তৈরি করা কঠিন নয়। আপনার বাড়ির রান্নাঘর, বাগান বা গবাদি পশুর বর্জ্য ব্যবহার করে সহজেই প্রাকৃতিক সার তৈরি করা যায়। নীচে কিছু সহজ পদ্ধতি দেওয়া হল:
১. কম্পোস্ট তৈরি
কম্পোস্ট হল জৈব সারের সবচেয়ে সাধারণ এবং কার্যকরী রূপ। এটি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী। কীভাবে কম্পোস্ট তৈরি করবেন:
উপকরণ: রান্নাঘরের বর্জ্য (শাকসবজির খোসা, ফলের খোসা, চা পাতা, ডিমের খোসা), শুকনো পাতা, ঘাসের কাটিং, গোবর, এবং পানি।
পদ্ধতি:
একটি বড় পাত্র বা গর্তে শুকনো পাতা এবং সবুজ বর্জ্য (যেমন ঘাস বা রান্নাঘরের বর্জ্য) ১:১ অনুপাতে স্তর করে রাখুন।
প্রতিটি স্তরে সামান্য গোবর বা পুরানো কম্পোস্ট ছিটিয়ে দিন। এটি পচন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে।
মিশ্রণটি আর্দ্র রাখতে পরিমিত পানি ছিটিয়ে দিন, তবে অতিরিক্ত পানি এড়িয়ে চলুন।
প্রতি ৭-১০ দিনে মিশ্রণটি উল্টে দিন যাতে অক্সিজেন প্রবেশ করে এবং পচন সমানভাবে হয়।
৬-৮ সপ্তাহ পরে, গাঢ় বাদামী রঙের কম্পোস্ট প্রস্তুত হবে, যা মাটিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়।
কম্পোস্টের ব্যবহার: ধান, আলু, টমেটো, বেগুন, এবং ফুলকপির মতো ফসলের জন্য কম্পোস্ট অত্যন্ত উপকারী। প্রতি একর জমিতে ২-৩ টন কম্পোস্ট ব্যবহার করলে ফলন বৃদ্ধি পায়।

২. ভার্মিকম্পোস্ট
ভার্মিকম্পোস্ট হল কেঁচোর সাহায্যে তৈরি জৈব সার, যা পুষ্টিগুণে ভরপুর। এটি তৈরির জন্য:
একটি ছায়াযুক্ত স্থানে কাঠের বাক্স বা প্লাস্টিকের পাত্রে গোবর, শুকনো পাতা এবং রান্নাঘরের বর্জ্য মিশিয়ে রাখুন।
এতে কেঁচো (যেমন Eisenia fetida) ছেড়ে দিন। প্রতি কেজি জৈব বর্জ্যের জন্য ১০০-১৫০টি কেঁচো প্রয়োজন।
৪৫-৬০ দিন পরে পুষ্টিকর ভার্মিকম্পোস্ট প্রস্তুত হবে।

৩. তরল জৈব সার
রান্নাঘরের বর্জ্য বা গোবর থেকে তরল সার তৈরি করা যায়:
একটি বালতিতে গোবর বা ফল-শাকসবজির খোসা পানির সাথে মিশিয়ে ৭-১০ দিন রেখে দিন।
মিশ্রণটি ছেঁকে তরল সার গাছের গোড়ায় বা পাতায় স্প্রে করুন। এটি দ্রুত পুষ্টি সরবরাহ করে।

৪. বানানা পিল ফার্টিলাইজার
কলার খোসায় পটাশিয়াম এবং ফসফরাস বেশি থাকে। এটি তৈরির জন্য:
কলার খোসা শুকিয়ে গুঁড়ো করে মাটিতে মেশান।
অথবা খোসা পানিতে ভিজিয়ে তরল সার হিসেবে ব্যবহার করুন।

Advertisements

কম্পোস্টের কৃষিতে ব্যবহার
কম্পোস্ট ব্যবহার করলে মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে, যা মাটির জল ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়। পশ্চিমবঙ্গের মাটি, বিশেষ করে লাল মাটি এবং পলি মাটিতে কম্পোস্ট ব্যবহার ফসলের ফলন ২০-৩০% বাড়াতে পারে। ধান চাষের সময় বীজ বপনের আগে ১-২ টন কম্পোস্ট প্রতি হেক্টরে মিশিয়ে দিলে মাটির উর্বরতা বজায় থাকে। শাকসবজি এবং ফলের চাষে প্রতি মাসে একবার কম্পোস্ট বা তরল সার ব্যবহার করা উচিত।

সুবিধা ও পরিবেশগত প্রভাব
জৈব সার এবং কম্পোস্ট ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকরা রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমাতে পারেন। এটি কৃষি খরচ ৩০-৪০% কমায় এবং মাটির দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। এছাড়া, জৈব বর্জ্য পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ হ্রাস পায়। পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় গোবর এবং ফসলের অবশিষ্টাংশ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, সেখানে জৈব সার তৈরি একটি লাভজনক বিকল্প হতে পারে।

সতর্কতা
কম্পোস্ট তৈরির সময় প্লাস্টিক, কাচ বা রাসায়নিক পদার্থ মেশানো থেকে বিরত থাকুন।
অতিরিক্ত তরল সার ব্যবহার করলে গাছের ক্ষতি হতে পারে, তাই পরিমিত ব্যবহার করুন।
ভার্মিকম্পোস্টের জন্য সঠিক কেঁচো নির্বাচন করুন এবং অতিরিক্ত তাপ বা আর্দ্রতা এড়ান।

সারের সংকট মোকাবিলায় ঘরে তৈরি জৈব সার এবং কম্পোস্ট একটি কার্যকর সমাধান। পশ্চিমবঙ্গের কৃষক এবং বাগানপ্রেমীরা এই পদ্ধতি গ্রহণ করে ফসলের গুণমান এবং উৎপাদন বাড়াতে পারেন। পরিবেশবান্ধব এই পদ্ধতি শুধুমাত্র খরচ কমায় না, বরং টেকসই কৃষির পথও প্রশস্ত করে। তাই, আজই শুরু করুন জৈব সার তৈরি এবং কম্পোস্ট ব্যবহার করে একটি সবুজ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলুন।