ভারতের কৃষি খাতে নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে সারের দামের (Fertilizer Price Hike) ঊর্ধ্বগতি। বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমদানি নির্ভরতার কারণে সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর আর্থিক চাপ বাড়ছে। ভারত, যিনি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সার আমদানিকারক দেশ, তিনি উরিয়া, ডায়ামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) এবং মিউরিয়েট অফ পটাশ (এমওপি)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সারের জন্য বিদেশের উপর নির্ভরশীল। ২০২৪-২৫ সালে সারের দাম বৃদ্ধি কৃষকদের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে, যা খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই প্রতিবেদনে আমরা সারের দাম বৃদ্ধির কারণ, এর প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।
সারের দাম বৃদ্ধির কারণ
বিশ্ববাজারে সারের কাঁচামাল যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস, ফসফরিক অ্যাসিড এবং অ্যামোনিয়ার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সারের দামে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে সারের সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হয়েছে। রাশিয়া এবং বেলারুশ, যারা বিশ্বের প্রধান সার রপ্তানিকারক দেশ, তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং রপ্তানি বিধিনিষেধ সারের দামকে আরও ঠেলে দিয়েছে। এছাড়াও, চীন, যিনি ভারতের ডিএপি-র একটি প্রধান সಸরবরাহকারী, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে ভারতে ডিএপি আমদানি ৭৫% কমে যাওয়ায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
২০২৪ সালের মে মাসে ডিএপি-র আন্তর্জাতিক মূল্য ছিল ৫১৫ ডলার প্রতি টন, যা অক্টোবরে বেড়ে ৬৪২ ডলারে পৌঁছেছে। উরিয়ার দামও ২০২২ সালের মে মাসে ৭২২ ডলার প্রতি টন থেকে ২০২৩ সালে ৩৩২ ডলারে নেমে গেলেও, ভারতের কৃষকদের জন্য এর দাম এখনও সাশ্রয়ী নয়। এই দাম বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ ভারত তার ২৫% উরিয়া, ৯৫% ফসফেট এবং ১০০% পটাশ আমদানি করে।
ক্ষুদ্র কৃষকদের উপর প্রভাব
ভারতের প্রায় ৮০% কৃষক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, যাদের জমির পরিমাণ দুই হেক্টরের কম। এই কৃষকরা ইতিমধ্যেই উচ্চ ঋণ, নিম্ন ফসলের দাম এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে লড়াই করছেন। সারের দাম বৃদ্ধি তাদের উৎপাদন খরচ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাবের কৃষক বালদেব সিং জানিয়েছেন, তিনি ডিএপি-র জন্য নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত ১০০০ টাকা দিয়ে কিনতে বাধ্য হয়েছেন।
২০২২ সালে, ডিএপি-র দাম প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ১২০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৯০০ টাকায় পৌঁছেছে, যা প্রায় ৫৮% বৃদ্ধি। এই দাম বৃদ্ধি কৃষকদের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি)-এর সুবিধাকে প্রায় বাতিল করে দিয়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদ টি.এন. প্রকাশ কাম্মারাদি জানিয়েছেন, এক একর ধান চাষের জন্য প্রায় ৪০০ কেজি সার প্রয়োজন, যার মধ্যে ডিএপি এবং এনপিকে-র অংশ প্রায় ৫০%। এই দাম বৃদ্ধির ফলে প্রতি একরে খরচ ২৮০০-৩০০০ টাকা বেড়ে গেছে, যা কৃষকদের আর্থিক বোঝা বাড়িয়েছে।
এছাড়াও, সারের ঘাটতি এবং কালোবাজারি সমস্যা আরও জটিলতা সৃষ্টি করছে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও সার পাচ্ছেন না, এবং অনেক সময় বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এই পরিস্থিতি কৃষকদের উৎপাদন হ্রাস করতে বাধ্য করছে, যা খাদ্য নিরাপত্তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
সরকারি পদক্ষেপ এবং চ্যালেঞ্জ
ভারত সরকার সারের দাম নিয়ন্ত্রণে ভর্তুকি প্রদান করে আসছে। ২০২৪-২৫ সালের খরিফ মরসুমের জন্য সরকার ফসফেটিক এবং পটাশিক সারের জন্য ২৪,৪২০ কোটি টাকার ভর্তুকি ঘোষণা করেছে। ডিএপি-র ভর্তুকি প্রতি টন ২০,৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭,৭৯৯ টাকা করা হয়েছে। তবে, এই ভর্তুকি সত্ত্বেও, আমদানি নির্ভরতা এবং বিশ্ববাজারের অস্থিরতার কারণে দাম নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
২০২৫-২৬ সালের বাজেটে সারের ভর্তুকির জন্য ১.৬৭ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৮-৯% বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ভর্তুকি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান নয়। ভারতের প্রায় ৬০% ডিএপি আমদানি করতে হয়, এবং চীন, সৌদি আরব এবং মরক্কোর মতো দেশগুলির উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজন।
সমাধানের পথ
কৃষি বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছেন:
- দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি: সার উৎপাদনের জন্য দেশীয় কারখানায় বিনিয়োগ বাড়ানো এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ উন্নত করা প্রয়োজন।
- বিকল্প সার: ন্যানো-উরিয়া এবং জৈব সারের মতো বিকল্পগুলির প্রচার বাড়ানো যেতে পারে। ২০২১ সালে ইফকো ন্যানো-উরিয়া চালু করেছে, যা প্রচলিত উরিয়ার প্রয়োজনীয়তা ৫০% কমাতে পারে।
- মাটি পরীক্ষা: মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সারের অপচয় কমানো এবং সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে।
- ভর্তুকি ব্যবস্থার সংস্কার: ভর্তুকি সরাসরি কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এবং কালোবাজারি রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
সারের দাম বৃদ্ধি ভারতের ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য একটি গুরুতর সংকট সৃষ্টি করেছে। উচ্চ উৎপাদন খরচ, ঘাটতি এবং কালোবাজারির কারণে কৃষকদের জীবিকা হুমকির মুখে। সরকারের ভর্তুকি এবং নীতিগত পদক্ষেপ স্বল্পমেয়াদী স্বস্তি দিলেও, দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি, বিকল্প সারের প্রচার এবং দক্ষ বিতরণ ব্যবস্থা প্রয়োজন। কৃষকদের সুরক্ষা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।