সেচের জন্য বিদ্যুৎ! বাংলার কৃষকরা সরকারের কাছে কী চায়?

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য সেচ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে রাজ্যের শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক অঞ্চলে যেমন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, এবং পশ্চিম মেদিনীপুর। সেচের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ…

Electricity for Irrigation 2025: Bengal Farmers Seek Government Support

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য সেচ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে রাজ্যের শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক অঞ্চলে যেমন বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, এবং পশ্চিম মেদিনীপুর। সেচের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ (Electricity for Irrigation) কৃষকদের উৎপাদনশীলতা এবং আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, বিদ্যুতের উচ্চ খরচ, অপর্যাপ্ত সরবরাহ, এবং অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে অনেক কৃষক এখনও ডিজেল-চালিত পাম্পের উপর নির্ভরশীল। ২০২৫ সালে বাংলার কৃষকরা সরকারের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ, সৌর-চালিত পাম্পের জন্য ভর্তুকি, এবং উন্নত অবকাঠামোর দাবি জানাচ্ছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব কৃষকদের প্রত্যাশা এবং সরকারের বিদ্যমান উদ্যোগগুলি।

কৃষকদের প্রধান দাবি
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা সেচের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নির্দিষ্ট দাবি উত্থাপন করেছেন:

   
  • সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ মূল্য: ডিজেল-চালিত পাম্পের তুলনায় বিদ্যুৎ-চালিত পাম্পের খরচ অনেক কম হলেও, বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি মূল্য এখনও অনেক কৃষকের জন্য বোঝা। উদাহরণস্বরূপ, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কৃষি বিদ্যুৎ সংযোগ যোজনায় কৃষকরা প্রতি ইউনিট ০.৫৫ টাকায় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন, যেখানে বাংলায় এই হার অনেক বেশি। কৃষকরা চান পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ধরনের ভর্তুকি চালু করুক।
  • নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ: গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রায়ই অনিয়মিত, বিশেষ করে বোরো ধান চাষের সময় (ডিসেম্বর থেকে মে)। এই সময়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কৃষকদের ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে।
  • সৌর-চালিত পাম্পের জন্য ভর্তুকি: সৌর-চালিত সেচ পাম্প পরিবেশবান্ধব এবং খরচ কমায়। তবে, এই পাম্পের ইনস্টলেশন খরচ (প্রায় ২.৩৭ লক্ষ টাকা) অনেক কৃষকের সামর্থ্যের বাইরে। পিএম কুসুম যোজনার আওতায় কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার ৬০% ভর্তুকি প্রদান করে, তবে বাংলায় এই প্রকল্পের প্রয়োগ ধীর। কৃষকরা আরও বেশি সংখ্যায় সৌর পাম্পের জন্য ভর্তুকি এবং সহজ ঋণের দাবি করছেন।
  • অবকাঠামো উন্নয়ন: গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ এবং ট্রান্সমিশন লাইনের অবকাঠামো দুর্বল। কৃষকরা চান সরকার এই অবকাঠামো উন্নত করুক এবং নতুন টিউবওয়েল স্থাপনের জন্য সহায়তা প্রদান করুক।

সরকারি উদ্যোগ: বর্তমান চিত্র
পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষকদের জন্য সেচের সুবিধা বাড়াতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে:

  • বাংলা কৃষি সেচ যোজনা: এই প্রকল্পের আওতায় ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ড্রিপ এবং স্প্রিংকলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য সম্পূর্ণ ভর্তুকি প্রদান করা হয়। ড্রিপ সেচের জন্য প্রতি একরে ৭০,০০০ টাকা এবং স্প্রিংকলার সেচের জন্য ২০,০০০ টাকা খরচ বহন করে সরকার। এই প্রকল্পটি পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার মতো কম বৃষ্টিপাতের অঞ্চলে কৃষকদের সাহায্য করছে।
  • সেচ বন্ধু প্রকল্প: এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৬,০০০ নতুন পাম্প সেটের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হচ্ছে। এটি বিদ্যুৎ চুরি কমাতে এবং গ্রামীণ এলাকায় নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে সহায়ক।
  • পিএম কুসুম যোজনা: কেন্দ্র সরকারের এই প্রকল্পের আওতায় সৌর-চালিত পাম্প স্থাপনের জন্য ৬০% ভর্তুকি দেওয়া হয়। তবে, বাংলায় এই প্রকল্পের অগ্রগতি ধীর, এবং মাত্র ১,০০০টি সৌর পাম্প স্থাপিত হয়েছে, যেখানে জাতীয়ভাবে ৩ লক্ষ সৌর পাম্প স্থাপিত হয়েছে।
  • ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাক্সিলারেটেড ডেভেলপমেন্ট অফ মাইনর ইরিগেশন প্রজেক্ট (WBADMIP): এই প্রকল্পটি টিউবওয়েল, চেক ড্যাম, এবং জলাশয়ের মতো ক্ষুদ্র সেচ কাঠামো তৈরির মাধ্যমে কৃষকদের সেচ সুবিধা প্রদান করে। এটি জল ব্যবহারকারী সমিতি (WUAs) গঠনের মাধ্যমে সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।

কৃষকদের চ্যালেঞ্জ
বাংলার কৃষকরা সেচের জন্য বিদ্যুৎ সংক্রান্ত বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন:

Advertisements
  • উচ্চ ইনস্টলেশন খরচ: সৌর পাম্প বা বিদ্যুৎ-চালিত টিউবওয়েল স্থাপনের প্রাথমিক খরচ অনেক কৃষকের জন্য বোঝা।
  • অপর্যাপ্ত অবকাঠামো: গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের অবকাঠামো দুর্বল, এবং ট্রান্সমিশন লাইনের ক্ষতি প্রায়ই ঘটে।
  • সচেতনতার অভাব: অনেক কৃষক সরকারি প্রকল্প, যেমন পিএম কুসুম যোজনা বা সেচ বন্ধু প্রকল্প সম্পর্কে অবগত নন। সরকারের প্রচারণা এখনও দুর্বল।
  • জলের অভাব: বাঁকুড়ার মতো অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ জলর স্তর কমে যাওয়ায় টিউবওয়েলের কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে।

সরকারের কাছে কৃষকদের প্রত্যাশা
২০২৫ সালে কৃষকরা সরকারের কাছে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি আশা করছেন:

  • ভর্তুকি বৃদ্ধি: সৌর পাম্প এবং বিদ্যুৎ-চালিত টিউবওয়েলের জন্য ভর্তুকি ৬০% থেকে বাড়িয়ে ৮০% করা।
  • হাইব্রিড পাম্পের প্রচলন: সৌর এবং বিদ্যুৎ-চালিত হাইব্রিড পাম্প স্থাপন, যা রাত্রি বা মেঘলা দিনেও কাজ করতে পারে।
  • সচেতনতা প্রচার: গ্রামীণ এলাকায় সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ক্যাম্প এবং প্রশিক্ষণের আয়োজন।
  • বিদ্যুৎ অবকাঠামো উন্নয়ন: গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন করতে ট্রান্সমিশন লাইন এবং সাবস্টেশন স্থাপন।

অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাব
সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ এবং সৌর-চালিত পাম্প কৃষকদের খরচ ৭-৮% কমাতে পারে এবং ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে। এছাড়া, ডিজেল পাম্পের পরিবর্তে বিদ্যুৎ বা সৌর পাম্প ব্যবহার কার্বন নির্গমন হ্রাস করবে, যা পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থনৈতিকভাবে, কৃষকদের বর্ধিত আয় গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়াবে।

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য সেচের জন্য বিদ্যুৎ একটি অপরিহার্য প্রয়োজন। সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, এবং সৌর-চালিত পাম্পের জন্য ভর্তুকি কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে। সরকারের বিদ্যমান প্রকল্পগুলি, যেমন বাংলা কৃষি সেচ যোজনা এবং সেচ বন্ধু প্রকল্প, ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, আরও বেশি প্রচারণা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। ২০২৫ সালে সরকার যদি কৃষকদের এই দাবিগুলি পূরণ করে, তবে বাংলার কৃষি খাতে একটি নতুন বিপ্লব সম্ভব।