পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতে একটি নীরব বিপ্লব চলছে। রাসায়নিক কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচলন ঘটাতে কৃষকরা এখন প্রাকৃতিক ও হার্বাল কীটনাশকের (Natural Insecticides) দিকে ঝুঁকছেন। বিশেষ করে লঙ্কা, বেগুন এবং ঢেঁড়সের মতো জনপ্রিয় সবজি চাষে এই প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই কীটনাশকগুলি শুধু ফসলের ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে কার্যকরই নয়, মাটির উর্বরতা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গে লঙ্কা, বেগুন ও ঢেঁড়স চাষে প্রাকৃতিক কীটনাশকের ব্যবহার, এর সুবিধা এবং কৃষকদের জন্য এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
প্রাকৃতিক কীটনাশক কী এবং কেন এর গুরুত্ব?
প্রাকৃতিক কীটনাশক হল উদ্ভিদ, খনিজ বা অন্যান্য জৈব উপাদান থেকে তৈরি কীটনাশক, যা রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়। এগুলি পরিবেশবান্ধব, মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ এবং মাটির জৈব বৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়ক। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা, বিশেষ করে নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূম এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলিতে, লঙ্কা, বেগুন এবং ঢেঁড়স চাষে প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা এবং ফসলের গুণগত মান বাড়াচ্ছেন।
রাসায়নিক কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার মাটির উর্বরতা হ্রাস, জল দূষণ এবং মানুষ ও প্রাণীদের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এই প্রেক্ষাপটে, প্রাকৃতিক কীটনাশক কৃষকদের জন্য একটি টেকসই বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে। এই পদ্ধতি জৈব চাষের প্রসারে সহায়তা করছে এবং ভোক্তাদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর সবজি সরবরাহ করছে।
লঙ্কা, বেগুন ও ঢেঁড়সে প্রাকৃতিক কীটনাশকের ব্যবহার
পশ্চিমবঙ্গে লঙ্কা, বেগুন এবং ঢেঁড়স চাষে বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গ যেমন ফল মাছি, পাতা খেকো পোকা, শুঁড়যুক্ত পোকা এবং এফিডস (মশা) সমস্যা সৃষ্টি করে। এই পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে কৃষকরা এখন নিম, তুলসী, রসুন, পেঁয়াজ এবং বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ থেকে তৈরি প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার করছেন। এই পদ্ধতিগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল:
নিমভিত্তিক কীটনাশক: নিমের তেল বা নিম পাতার নির্যাস অত্যন্ত কার্যকরী প্রাকৃতিক কীটনাশক। এটি ফল মাছি এবং এফিডসের মতো পোকামাকড় দূর করতে সাহায্য করে। নদিয়ার কৃষক বিমল মণ্ডল জানান, “নিমের তেল মিশ্রিত জল স্প্রে করলে আমার লঙ্কা গাছের পোকার সমস্যা ৮০% কমে গেছে।” নিমের তেল ফসলের গুণগত মানের উপর কোনও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না এবং এটি জৈব চাষের জন্য আদর্শ।
রসুন ও পেঁয়াজের নির্যাস: রসুন এবং পেঁয়াজের তীব্র গন্ধ পোকামাকড়কে দূরে রাখে। এই নির্যাস তৈরি করতে রসুন বা পেঁয়াজ পিষে জলের সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করা হয়। বীরভূমের কৃষক সুশান্ত মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই পদ্ধতি বেগুন চাষে পাতা খেকো পোকা নিয়ন্ত্রণে খুবই কার্যকর। এটি সস্তা এবং সহজলভ্য।”
তুলসী ও ধনিয়ার নির্যাস: তুলসী পাতার নির্যাস এবং ধনিয়ার রস পোকামাকড়ের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে। এটি ঢেঁড়স চাষে শুঁড়যুক্ত পোকার বিরুদ্ধে কার্যকর। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কৃষক মিনতি হালদার জানান, “তুলসী নির্যাস ব্যবহারে আমার ঢেঁড়স ফসলের ক্ষতি অনেকটাই কমেছে।”
গাঁদা ফুলের ব্যবহার: গাঁদা ফুলের গন্ধ পোকামাকড়কে তাড়ায়। অনেক কৃষক লঙ্কা এবং বেগুনের ক্ষেতে গাঁদা ফুলের গাছ লাগিয়ে প্রাকৃতিকভাবে পোকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই পদ্ধতি, যা ‘ট্র্যাপ ক্রপিং’ নামে পরিচিত, কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
পরিবেশবান্ধব কৃষির সুবিধা
প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা একাধিক সুবিধা পাচ্ছেন:
পরিবেশ সংরক্ষণ: রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমায় মাটি, জল এবং বায়ুর দূষণ হ্রাস পাচ্ছে। এটি জৈব বৈচিত্র্য যেমন মৌমাছি এবং প্রজাপতির মতো উপকারী পোকামাকড়ের জন্য নিরাপদ।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা: প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহারে ফসল নিরাপদ এবং ভোক্তাদের জন্য স্বাস্থ্যকর হয়। এটি রাসায়নিক দ্রব্যের অবশিষ্টাংশের ঝুঁকি কমায়।
খরচ সাশ্রয়: নিম, তুলসী, রসুনের মতো উপাদান স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়, যা রাসায়নিক কীটনাশকের তুলনায় সস্তা। মুর্শিদাবাদের কৃষক অমিত সাহা বলেন, “প্রাকৃতিক কীটনাশক তৈরিতে আমার খরচ প্রায় ৬০% কমেছে।”
বাজার চাহিদা: জৈব সবজির ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে কৃষকরা বেশি দামে তাদের ফসল বিক্রি করতে পারছেন। কলকাতা এবং অন্যান্য শহরে জৈব বাজারে লঙ্কা, বেগুন এবং ঢেঁড়সের চাহিদা বাড়ছে।
সরকার ও সংস্থার ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং বিভিন্ন কৃষি সংস্থা প্রাকৃতিক কীটনাশকের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পশ্চিমবঙ্গ জৈব বৈচিত্র্য বোর্ড (WBBB) এবং কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (ATC) কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। নদিয়ার ATC-এর সহকারী পরিচালক অনুপম পাল বলেন, “আমরা কৃষকদের প্রাকৃতিক কীটনাশক তৈরি ও ব্যবহার শেখাচ্ছি। এটি জৈব চাষের জন্য একটি গেম-চেঞ্জার।” এছাড়া, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (KVK) এবং স্থানীয় এনজিওগুলি গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘বাংলার শস্য বিমা’ এবং জৈব চাষ প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ২০২৪-২৫ সালের রাজ্য বাজেটে জৈব চাষের জন্য ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা প্রাকৃতিক কীটনাশকের প্রচলনকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
প্রাকৃতিক কীটনাশকের ব্যবহার বাড়লেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, এই পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক কীটনাশকের প্রভাব রাসায়নিক কীটনাশকের তুলনায় কিছুটা ধীরে কাজ করে, যা কিছু কৃষককে দ্বিধায় ফেলে। তৃতীয়ত, বাজারে জৈব সবজির জন্য পর্যাপ্ত সাপ্লাই চেইন এবং সার্টিফিকেশন ব্যবস্থার অভাব।
তবে, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা উজ্জ্বল। পশ্চিমবঙ্গে জৈব চাষের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, এবং ভোক্তারা ক্রমশ জৈব সবজির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। কলকাতার মতো শহরে জৈব বাজার এবং ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলি কৃষকদের সরাসরি ভোক্তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে জৈব পণ্যের চাহিদা বাড়ায় কৃষকরা লঙ্কা এবং বেগুন রপ্তানির সুযোগ পাচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গে লঙ্কা, বেগুন এবং ঢেঁড়স চাষে প্রাকৃতিক কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকদের জন্য একটি টেকসই এবং লাভজনক পথ উন্মোচন করছে। নিম, তুলসী, রসুন এবং গাঁদার মতো স্থানীয় উপাদান ব্যবহার করে কৃষকরা পরিবেশ ও স্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি খরচ কমাচ্ছেন। সরকার এবং সংস্থাগুলির সহায়তায় এই প্রচেষ্টা আরও গতি পাবে। প্রাকৃতিক কীটনাশকের ব্যবহার শুধু কৃষি নয়, পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যৎ গঠনের ক্ষেত্রেও একটি মাইলফলক হয়ে উঠছে।