পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ক্ষেত্রে একটি নতুন বিপ্লব শুরু হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ধান, গম, বা সরিষার চাষের পাশাপাশি এখন কৃষকরা বহিরাগত ফল (Exotic Fruit Farming) যেমন ড্রাগন ফ্রুট, অ্যাভোকাডো, কিউই, এবং প্যাশন ফ্রুটের মতো উচ্চমূল্যের ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। এই ফলগুলি শুধুমাত্র পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ নয়, বরং দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চ চাহিদার কারণে কৃষকদের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক লাভের সম্ভাবনা তৈরি করছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা, বিশেষ করে পশ্চিম মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি, এবং উত্তর দিনাজপুরের মতো অঞ্চলে, এই বহিরাগত ফল চাষের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা দেখব কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে ড্রাগন ফ্রুট এবং অ্যাভোকাডো চাষ কৃষকদের জন্য লাভজনক হয়ে উঠছে এবং এই ক্ষেত্রে কী কী সম্ভাবনা রয়েছে।
ড্রাগন ফ্রুট: পশ্চিমবঙ্গের নতুন ফসলের তারকা
ড্রাগন ফ্রুট, যিনি ‘কমলম’ নামেও পরিচিত, পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই ফলটি ১৯৯০-এর দশকে ভারতে প্রথম চাষ শুরু হয়, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এর উচ্চ রপ্তানি মূল্য এবং কম রক্ষণাবেক্ষণের কারণে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের কৃষকরা, যেমন প্রভা তিরকি চাকো, ২০১৬ সাল থেকে ড্রাগন ফ্রুট চাষ শুরু করেছেন এবং ২০১৮ সালে প্রতি কেজি ৪৫০ টাকায় ফল বিক্রি করে উল্লেখযোগ্য লাভ করেছেন।
ড্রাগন ফ্রুট চাষে প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রতি একরে ৫ থেকে ৭ লক্ষ টাকা হলেও, এই ফসলের আয়ুষ্কাল ২০-২৫ বছর এবং এটি কম পানির প্রয়োজন হয়, যা পশ্চিমবঙ্গের শুষ্ক এলাকাগুলির জন্য আদর্শ। প্রতি একরে ১৭০০-২০০০ গাছ লাগানো যায়, এবং তৃতীয় বছর থেকে ৮-১০ টন ফলন পাওয়া সম্ভব, যা প্রতি একরে ৫ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা লাভ দিতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের হর্টিকালচার প্রোগ্রামের মাধ্যমে প্রতি হেক্টরে ১.৬ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি প্রদান করছে, যা কৃষকদের জন্য এই চাষকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলছে।
২০২১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের কৃষকদের উৎপাদিত ড্রাগন ফ্রুট লন্ডন এবং বাহরাইনে রপ্তানি হয়েছে, যা এই ফলের আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা প্রমাণ করে। এই ফলের উচ্চ ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট মূল্য এটিকে শহরাঞ্চলের স্বাস্থ্যসচেতন গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা এখন এই ফলের রেড, হোয়াইট, এবং ইয়েলো জাতের চাষ করছেন, যেখানে রেড জাতের দাম প্রতি কেজি ১৫০-৩০০ টাকা।
অ্যাভোকাডো: নতুন সম্ভাবনার ফসল
অ্যাভোকাডো, যিনি ‘বাটার ফ্রুট’ নামে পরিচিত, পশ্চিমবঙ্গের কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তর দিনাজপুর এবং দার্জিলিংয়ে, চাষ শুরু হয়েছে। এই ফলটি উচ্চ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এবং প্রতি কেজি ১৫০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। অ্যাভোকাডো চাষে প্রাথমিক বিনিয়োগ প্রায় ১.১৯ লক্ষ টাকা প্রতি একর, এবং তৃতীয় বছর থেকে প্রতি একরে ৪০০০ কেজি ফলন সম্ভব, যা ৬.৮১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লাভ দিতে পারে। তবে, অ্যাভোকাডো গাছের পূর্ণ ফলন পেতে ৭-১০ বছর সময় লাগে, যা ড্রাগন ফ্রুটের তুলনায় বেশি সময়সাপেক্ষ।
পশ্চিমবঙ্গের উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ু অ্যাভোকাডো চাষের জন্য উপযুক্ত। এই ফলটি সালাদ, স্মুদি, এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর খাবারে ব্যবহৃত হয়, যা শহরের গ্রাহকদের কাছে জনপ্রিয়। কেন্দ্রীয় সরকার ২০২১ সালে অ্যাভোকাডোকে উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং এর চাষের জন্য ২০২১-২২ সালে ৮,৯৫১ হেক্টর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই ফলের চাষ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে কৃষকরা ধীরে ধীরে এর সম্ভাবনা বুঝতে পারছেন।
অন্যান্য বহিরাগত ফল
ড্রাগন ফ্রুট এবং অ্যাভোকাডো ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে লিচু, স্টারফ্রুট, এবং প্যাশন ফ্রুটের মতো ফলের চাষও বাড়ছে। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি এবং মালদায় লিচু চাষ দীর্ঘদিন ধরে লাভজনক, এবং প্রতি একরে ৮-১০ টন ফলন ৫-৭ লক্ষ টাকা আয় করে। স্টারফ্রুট এবং প্যাশন ফ্রুটের চাষ দক্ষিণবঙ্গের কিছু অঞ্চলে শুরু হয়েছে, যা প্রতি একরে ৪-৬ লক্ষ টাকা আয়ের সম্ভাবনা তৈরি করছে। এই ফলগুলির উচ্চ চাহিদা শহরের হোটেল, রেস্তোরাঁ, এবং স্বাস্থ্যসচেতন গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে।
চাষের কৌশল এবং চ্যালেঞ্জ
বহিরাগত ফল চাষে সফলতার জন্য কিছু বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। প্রথমত, জলবায়ু এবং মাটির গুণমান গুরুত্বপূর্ণ। ড্রাগন ফ্রুটের জন্য ৫.৫-৭ পিএইচ সহ বেলে দোআঁশ মাটি আদর্শ, যেখানে অ্যাভোকাডোর জন্য ল্যাটেরাইট মাটি উপযুক্ত। দ্বিতীয়ত, সঠিক সেচ ব্যবস্থা, যেমন ড্রিপ ইরিগেশন, পানির ব্যবহার কমায় এবং ফলন বাড়ায়। তৃতীয়ত, কীটপতঙ্গ এবং রোগ ব্যবস্থাপনার জন্য জৈব কীটনাশক এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। অবশেষে, ফল সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের সময় সঠিক কৌশল ব্যবহার করা উচিত যাতে ফলের গুণমান অক্ষুণ্ণ থাকে।
চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক বিনিয়োগের উচ্চ খরচ এবং বাজার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। তবে, সরকারি ভর্তুকি এবং কৃষি গবেষণা কেন্দ্রগুলির প্রশিক্ষণ এই সমস্যাগুলি মোকাবিলায় সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা এপিইডিএ-এর মাধ্যমে রপ্তানি সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গে বহিরাগত ফল চাষ কৃষকদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। ড্রাগন ফ্রুট এবং অ্যাভোকাডোর মতো ফসল শুধুমাত্র আর্থিক লাভই নয়, বরং কৃষি বৈচিত্র্য এবং টেকসই উন্নয়নেও অবদান রাখছে। সরকারি সহায়তা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, এবং বাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে এই ফলগুলির চাষ পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক বিকল্প হয়ে উঠছে। আগামী দিনে আরও কৃষক এই দিকে ঝুঁকলে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের বহিরাগত ফল চাষের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।