ডাইরেক্ট-টু-কনজিউমার মডেলে কৃষকের আয়ে নতুন দিগন্ত

প্রত্যক্ষ ভোক্তা বিক্রয় বা ডাইরেক্ট-টু-কনজিউমার (D2C) মডেল কৃষকদের জন্য একটি বিপ্লবী পদ্ধতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, (Direct To Consumer) যা কৃষি পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে…

Direct To Consumer model for farmers

প্রত্যক্ষ ভোক্তা বিক্রয় বা ডাইরেক্ট-টু-কনজিউমার (D2C) মডেল কৃষকদের জন্য একটি বিপ্লবী পদ্ধতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, (Direct To Consumer) যা কৃষি পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে কৃষকদের আয় বাড়াতে সহায়ক হচ্ছে। এই ‘ফার্ম টু ফর্ক’ (খামার থেকে রান্নাঘর) পদ্ধতিতে মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা হ্রাস করে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল, ফল, শাকসবজি, দুগ্ধজাত পণ্য বা প্রক্রিয়াজাত খাদ্য সরাসরি গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছেন।

এই মডেল কৃষকদের লাভের হার বাড়ানোর পাশাপাশি ভোক্তাদের জন্য তাজা এবং মানসম্পন্ন পণ্য নিশ্চিত করছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষিনির্ভর রাজ্যে এই পদ্ধতি কৃষকদের আর্থিক স্বনির্ভরতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

   

D2C মডেল কী এবং এর গুরুত্ব

প্রত্যক্ষ ভোক্তা বিক্রয় মডেলে কৃষকরা তাদের পণ্য সরাসরি গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করেন, যেখানে পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা বা অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা থাকে না। এই পদ্ধতিতে কৃষকরা তাদের পণ্যের দাম নিজেরা নির্ধারণ করতে পারেন, যার ফলে তারা বাজার মূল্যের পুরোটাই পান।

উদাহরণস্বরূপ, সাধারণ বাজারে এক কেজি টমেটোর জন্য কৃষকরা যেখানে ১০-১৫ টাকা পান, সেখানে D2C মডেলে তারা ৩০-৪০ টাকা পেতে পারেন। এছাড়া, ভোক্তারা তাজা এবং জৈব পণ্য সরাসরি খামার থেকে পান, যা তাদের স্বাস্থ্য ও মানের প্রতি আস্থা বাড়ায়।কৃষকদের জন্য আর্থিক সুবিধা

D2C মডেল কৃষকদের আয় বাড়াতে একাধিক উপায়ে সহায়ক। প্রথমত, মধ্যস্থতাকারীদের বাদ দেওয়ায় কৃষকরা তাদের পণ্যের পুরো মূল্য পান, যা তাদের লাভের পরিমাণ ৩০-৫০% বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, এই মডেলে কৃষকরা তাদের ব্র্যান্ড তৈরি করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের কৃষকরা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব ধান বা সবজি সরাসরি গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে তাদের ‘জৈব’ ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠা করছেন।

তৃতীয়ত, D2C মডেলে কৃষকরা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন পরিকল্পনা করতে পারেন, যা ফসলের অপচয় কমায়।পশ্চিমবঙ্গে, ফার্মার্স প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (এফপিও) এবং কৃষক সমবায় সমিতিগুলো D2C মডেল গ্রহণ করছে।

উদাহরণস্বরূপ, হাওড়া ও হুগলির কৃষকরা মোবাইল অ্যাপ এবং সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে তাদের জৈব শাকসবজি এবং ফল শহরের গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এই মডেলে তারা প্রতি মাসে ২০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা অতিরিক্ত আয় করছেন।

প্রযুক্তির ভূমিকা

D2C মডেলের সাফল্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মোবাইল অ্যাপ, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক মাধ্যম কৃষকদের সরাসরি গ্রাহকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সহায়তা করছে। ভারত সরকারের e-NAM (ইলেকট্রনিক ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট) প্ল্যাটফর্ম এবং স্থানীয় স্টার্টআপগুলো কৃষকদের তাদের পণ্য অনলাইনে বিক্রির সুযোগ দিচ্ছে।

Advertisements

পশ্চিমবঙ্গে, কৃষি দপ্তর এবং স্থানীয় এনজিও কৃষকদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মেদিনীপুরের একটি এফপিও গ্রুপ তাদের জৈব ধান এবং শাকসবজি কলকাতার গ্রাহকদের কাছে একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বিক্রি করছে, যা তাদের আয় দ্বিগুণ করেছে।

পরিবেশগত ও সামাজিক সুবিধা

D2C মডেল কেবল আর্থিকভাবে লাভজনক নয়, এটি পরিবেশ ও সমাজের জন্যও উপকারী। এই মডেলে পণ্য পরিবহন এবং সংরক্ষণের সময় কম লাগে, ফলে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পায়। এছাড়া, ভোক্তারা জৈব এবং তাজা পণ্য পাওয়ায় তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। কৃষক এবং গ্রাহকদের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।

এই স্প্যানিশ মিডফিল্ডারকে দলে টানার পথে গোকুলাম

সরকারি সহায়তা ও চ্যালেঞ্জ

ভারত সরকার D2C মডেলকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রণালয় এফপিও গঠন এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রচারে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে।

তবে, এই মডেলে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব, পরিবহন পরিকাঠামোর সমস্যা এবং ছোট কৃষকদের জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগের ঘাটতি। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার এবং বেসরকারি খাতের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

প্রত্যক্ষ ভোক্তা বিক্রয় বা D2C মডেল কৃষকদের জন্য একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এই পদ্ধতি কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা এই মডেল গ্রহণ করে তাদের আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেন। সরকারি সহায়তা এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে D2C মডেল ভারতের কৃষি খাতে একটি বিপ্লব আনতে পারে।