ভারতের কৃষি খাতে চুক্তিভিত্তিক কৃষি (Farming) এবং কর্পোরেট কৃষি (কর্পোরেট ফার্মিং) নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলছে। উভয় ব্যবস্থাই কৃষকদের আয়ের নিরাপত্তা এবং কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রবর্তিত হলেও, এদের সুবিধা ও অসুবিধা ভারতের কৃষক সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে। চুক্তিভিত্তিক কৃষি এবং কর্পোরেট কৃষির মধ্যে পার্থক্য এবং কোনটি কৃষকদের জন্য বেশি উপযোগী, তা নিয়ে আলোচনা আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
চুক্তিভিত্তিক কৃষি: সুবিধা ও চ্যালেঞ্জ
চুক্তিভিত্তিক কৃষিতে কৃষকরা বেসরকারি সংস্থা বা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে নির্দিষ্ট ফসল উৎপাদন করেন। এই চুক্তিতে ফসলের দাম, পরিমাণ এবং গুণমান পূর্বনির্ধারিত থাকে। এই ব্যবস্থার প্রধান সুবিধা হলো কৃষকদের আয়ের নিরাপত্তা। বাজারের দরের ওঠানামার ঝুঁকি থেকে তারা মুক্ত থাকেন, কারণ চুক্তিতে নির্ধারিত দামে ফসল বিক্রি নিশ্চিত হয়।
এছাড়া, কোম্পানিগুলো প্রায়শই বীজ, সার, এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে, যা কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমায় এবং ফলন বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, পেপসিকো এবং আইটিসি-র মতো সংস্থাগুলো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আলু, টমেটো এবং ধানের জন্য চুক্তিভিত্তিক কৃষি প্রকল্প চালাচ্ছে।তবে, এই ব্যবস্থার কিছু অসুবিধাও রয়েছে।
কৃষকরা প্রায়শই কোম্পানির শর্তের কাছে বাধ্য থাকেন, যা তাদের স্বাধীনতা হ্রাস করে। চুক্তি ভঙ্গ বা ফসলের গুণমান নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রে কৃষকরা আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন। এছাড়া, ছোট কৃষকদের জন্য চুক্তি পাওয়া কঠিন, কারণ বড় কোম্পানিগুলো প্রায়শই বড় জমির মালিকদের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করে।
কর্পোরেট কৃষি: সম্ভাবনা ও ঝুঁকি
কর্পোরেট কৃষিতে বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলো নিজেরা জমি কিনে বা ইজারা নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে কৃষি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই ব্যবস্থায় উন্নত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি, এবং পুঁজির ব্যবহার উৎপাদন বাড়ায় এবং ফসলের গুণমান নিশ্চিত করে। ভারতের কিছু অঞ্চলে, যেমন গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে, কর্পোরেট কৃষি ফল ও শাকসবজি উৎপাদনে সফলতা দেখিয়েছে।
এই ব্যবস্থা কৃষিতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন নিশ্চিত করে।কিন্তু কর্পোরেট কৃষিরও বেশ কিছু অসুবিধা রয়েছে। এটি ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে, কারণ বড় সংস্থাগুলো জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে তাদের জীবিকা কেড়ে নিতে পারে।
২০২০ সালে ভারতের কৃষি আইন সংস্কারের সময় কর্পোরেট কৃষি নিয়ে কৃষকদের মধ্যে যে বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল, তা এই ব্যবস্থার প্রতি তাদের আশঙ্কার প্রতিফলন। এছাড়া, কর্পোরেট কৃষি পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ এটি প্রায়শই রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহারের উপর নির্ভর করে।
কৃষকদের আয়ের নিরাপত্তা: কোনটি বেশি কার্যকর?
কৃষকদের আয়ের নিরাপত্তার দিক থেকে চুক্তিভিত্তিক কৃষি বেশি সুবিধাজনক বলে মনে করা হয়। এটি কৃষকদের বাজারের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে এবং নিশ্চিত আয় প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় চুক্তিভিত্তিক কৃষির মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফসলের জন্য ন্যূনতম মূল্য নিশ্চিত করতে পেরেছেন। অন্যদিকে, কর্পোরেট কৃষি বড় সংস্থাগুলোর লাভের উপর বেশি জোর দেয়, যা কৃষকদের জন্য সরাসরি আয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। বরং, এটি কৃষকদের জমি হারানোর ঝুঁকি বাড়ায়।
পোস্ট অফিসে এখন ব্যাঙ্কিং সুবিধা? জেনে নিন কী কী পরিবর্তন আসছে
কোনটি ভালো?
চুক্তিভিত্তিক কৃষি এবং কর্পোরেট কৃষি উভয়েরই সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে। ভারতের মতো দেশে, যেখানে বেশিরভাগ কৃষক ছোট এবং প্রান্তিক, চুক্তিভিত্তিক কৃষি তাদের জন্য বেশি উপযোগী। এটি তাদের জমি এবং স্বাধীনতা বজায় রেখে আয়ের নিরাপত্তা দেয়। তবে, চুক্তির স্বচ্ছতা এবং কৃষকদের অধিকার সুরক্ষার জন্য কঠোর নীতিমালা প্রয়োজন।
অন্যদিকে, কর্পোরেট কৃষি বড় আকারে উৎপাদন এবং রপ্তানির জন্য উপযোগী হলেও, এটি ছোট কৃষকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারের উচিত উভয় ব্যবস্থার সুবিধাগুলো একত্রিত করে এমন একটি মডেল তৈরি করা, যা কৃষকদের আয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং একইসঙ্গে কৃষি উৎপাদন বাড়াবে।
এজন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) মডেল এবং কৃষক উৎপাদক সংগঠন (এফপিও) গঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারতের কৃষি খাতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতির উপর, যা কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।