জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গাঙ্গেয় সমভূমিতে ধান চাষে কীভাবে প্রভাব ফেলছেয

গাঙ্গেয় সমভূমি ভারতের কৃষি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যেখানে ধান চাষ (Rice Farming) কৃষকদের জীবিকার প্রধান ভিত্তি। পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যগুলির এই…

Government Revises Urea Subsidy for 2025-26: Impact on Fertilizer Prices and Farming Costs in India

গাঙ্গেয় সমভূমি ভারতের কৃষি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, যেখানে ধান চাষ (Rice Farming) কৃষকদের জীবিকার প্রধান ভিত্তি। পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যগুলির এই সমভূমি অঞ্চল ভারতের মোট ধান উৎপাদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সরবরাহ করে। তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি এই অঞ্চলে ধান চাষের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। গাঙ্গেয় সমভূমিতে ধান চাষের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ফসলের ফলন কমিয়ে দিচ্ছে, কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। এই নিবন্ধে আমরা গাঙ্গেয় সমভূমিতে ধান চাষের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং কৃষকদের মানিয়ে নেওয়ার কৌশলগুলি বিশ্লেষণ করব।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: তাপমাত্রা বৃদ্ধি
গাঙ্গেয় সমভূমিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব হলো গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধি। গবেষণা অনুসারে, গত কয়েক দশকে ভারতের এই অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে, রাত্রিকালীন তাপমাত্রা দিনের তাপমাত্রার তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ধানের ফলন এবং গুণগত মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ধান চাষের জন্য সর্বোত্তম তাপমাত্রা পরিসীমা ২২-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে, গাঙ্গেয় সমভূমির কিছু অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা ইতিমধ্যে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেছে, যা ফসলের প্রজনন পর্যায়ে, বিশেষ করে ফুল ফোটার সময়, স্পাইকলেট বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়।

   

২০১৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, গোমতী নদী অববাহিকায় ধানের ফলন প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রায় ৫-৭% হ্রাস পায়। এই অঞ্চলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ধানের বৃদ্ধির সময়কাল, বিশেষ করে ফুল ফোটার আগের প্রজনন পর্যায়, উল্লেখযোগ্যভাবে সংক্ষিপ্ত হয়েছে। এটি ফসলের ফলন এবং শস্যের গুণগত মানের উপর প্রভাব ফেলে, যেমন শস্যে স্টার্চ এবং প্রোটিনের পরিমাণ হ্রাস পায়। উপরন্তু, বর্ধিত রাত্রিকালীন তাপমাত্রা ধানের শস্য ভরাট পর্যায়ে বাধা সৃষ্টি করে, যার ফলে শস্যের আকার এবং ওজন কমে যায়।

অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং জলের ঘাটতি
গাঙ্গেয় সমভূমিতে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ধরনও পরিবর্তিত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১৯৫০ সাল থেকে ভারতীয় গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বৃষ্টিপাত কমছে, এবং গাঙ্গেয় সমভূমিতে এই প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। মৌসুমের শুরুতে বিলম্ব এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণে অনিয়মিততা ধান চাষের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২০০৯-২০১০ সালে, মৌসুমী বৃষ্টিপাতের দেরি এবং অন্তঃস্থলীয় পরিবর্তনশীলতার কারণে ভারতের ধান উৎপাদন প্রায় ১০ মিলিয়ন টন কমে গিয়েছিল।

অন্যদিকে, অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং বন্যার ঘটনাও ধান চাষের জন্য ক্ষতিকর। পশ্চিমবঙ্গের নিম্নাঞ্চলীয় এলাকায়, যেমন মেদিনীপুর এবং হুগলি, বন্যার কারণে ধান ক্ষেত প্লাবিত হয়, যা ফসলের ক্ষতি করে। এই অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ত জলের অনুপ্রবেশও একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এবং ধানের ফলন কমিয়ে দেয়।

ধান চাষে মিথেন নির্গমন এবং জলবায়ু পরিবর্তন
ধান চাষ শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার নয়, এটি নিজেও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের একটি উৎস। প্লাবিত ধান ক্ষেতে মিথেন নির্গমন বিশ্বব্যাপী মানবসৃষ্ট মিথেন নির্গমনের প্রায় ১০% জন্য দায়ী। পশ্চিমবঙ্গে, ঐতিহ্যবাহী ধান চাষ পদ্ধতি, যেমন ক্রমাগত প্লাবন এবং ধানের খড় পোড়ানো, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমন বাড়ায়। এই গ্যাসগুলি জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করে, যা কৃষকদের জন্য একটি দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে।

Advertisements

কৃষকদের মানিয়ে নেওয়ার কৌশল
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা বিভিন্ন অভিযোজন কৌশল গ্রহণ করছেন। উদাহরণস্বরূপ, কিছু কৃষক তাপ-সহনশীল এবং খরা-প্রতিরোধী ধানের জাত, যেমন স্বর্ণা-সাব-১ বা সাহাভাগী ধান, ব্যবহার করছেন। এই জাতগুলি উচ্চ তাপমাত্রা এবং জলের ঘাটতি সহ্য করতে পারে। এছাড়াও, ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি (সিএসএ) পদ্ধতি, যেমন অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রাইং (এডব্লিউডি) পদ্ধতি, জলের ব্যবহার কমিয়ে এবং মিথেন নির্গমন হ্রাস করে ধান চাষকে আরও টেকসই করছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বিভাগ এই পদ্ধতিগুলির প্রচারে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে।

এছাড়াও, কৃষকরা বীজ বপনের সময়সূচী পরিবর্তন করছেন এবং জল সংরক্ষণের জন্য ড্রিপ ইরিগেশনের মতো আধুনিক সেচ পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। কিছু এলাকায়, কৃষকরা ধানের পরিবর্তে কম জল-নির্ভর ফসল, যেমন ভুট্টা বা ডাল, চাষের দিকে ঝুঁকছেন। তবে, ধানের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী ফসলের সঙ্গে সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক সংযোগের কারণে এই পরিবর্তন সহজ নয়।

গবেষণা ও প্রযুক্তির ভূমিকা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গবেষণা এবং প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইআরআরআই) এবং ভারতের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি তাপ-সহনশীল এবং লবণাক্ত জল-প্রতিরোধী ধানের জাত তৈরি করছে। উদাহরণস্বরূপ, সিআরআইএসপিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন ধানের জাত তৈরি করা হচ্ছে যা উচ্চ তাপমাত্রা এবং বন্যার মতো চরম পরিস্থিতি সহ্য করতে পারে এবং মিথেন নির্গমন কমায়। পশ্চিমবঙ্গে, এই ধরনের জাত পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করা হচ্ছে, এবং প্রাথমিক ফলাফল আশাব্যঞ্জক।

গাঙ্গেয় সমভূমিতে জলবায়ু পরিবর্তন ধান চাষের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ফসলের ফলন এবং কৃষকদের জীবিকার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তবে, ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি পদ্ধতি, তাপ-সহনশীল জাত এবং প্রযুক্তির ব্যবহার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আশার আলো দেখাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির উচিত কৃষকদের প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অভিযোজন কৌশলগুলির প্রচারে আরও জোর দেওয়া। এই সমস্যার মোকাবিলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া, গাঙ্গেয় সমভূমির ধান চাষ এবং খাদ্য নিরাপত্তা ভবিষ্যতে আরও বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।