ভারতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো কৃষি (Agriculture), যা দেশের প্রায় ২০% জিডিপিতে অবদান রাখে এবং ৪৫-৬০% কর্মশক্তির জীবিকা নির্বাহ করে। তবে, অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া, বাজারের অস্থিরতা, সার ও বীজের উচ্চমূল্য, এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর কারণে কৃষকদের লাভের পরিমাণ কমছে। এই প্রেক্ষিতে, অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—কৃষি কি আবার লাভজনক হতে পারে? বিশেষজ্ঞ এবং সফল কৃষকদের গল্প থেকে জানা যায়, সঠিক কৌশল, প্রযুক্তি, এবং বাজার কৌশলের মাধ্যমে কৃষি লাভজনক হতে পারে। এই প্রতিবেদনে আমরা ভারতের কিছু সফল কৃষি উদ্যোগের কেস স্টাডি এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে আলোচনা করব।
কৃষি কেন লাভজনক নয়?
ভারতীয় কৃষকরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। ২০১৯ সালে ভারতের দুর্বল মৌসুমী বৃষ্টির কারণে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ফসলের ক্ষতি হয়েছিল। এছাড়া, বাজারের অস্থিরতা এবং মধ্যস্থতাকারীদের কারণে কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান না। অপর্যাপ্ত সেচ ব্যবস্থা (মাত্র ৫২.৬% জমি সেচের আওতায়), জমির ক্ষুদ্র আকার (গড়ে ২ হেক্টরের কম), এবং ঋণের সুদের উচ্চ হার কৃষকদের লাভ কমিয়ে দেয়। তবে, কিছু কৃষক এবং উদ্যোক্তা উদ্ভাবনী পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সাফল্য অর্জন করেছেন।
সফল কৃষকদের কেস স্টাডি
১. রমেশ চন্দ্র দাগর: হরিয়ানার জৈব কৃষি সাফল্য
হরিয়ানার সোনিপতের অকবরপুর বারোটা গ্রামের কৃষক রমেশ চন্দ্র দাগর এক হেক্টর জমিতে জৈব কৃষির মাধ্যমে বছরে ১০ লক্ষ টাকার আয় করছেন। তিনি জৈব কৃষির সঙ্গে মৌমাছি পালন, গো-পালন, বায়োগ্যাস উৎপাদন, জল সংরক্ষণ, এবং কম্পোস্টিংয়ের সমন্বয় ঘটিয়েছেন। দাগর বলেন, “জৈব কৃষি কেবল কীটনাশক ব্যবহার না করা নয়, এটি পরিবেশ এবং অর্থনীতির জন্য একটি সমন্বিত পদ্ধতি।” তিনি উচ্চ মূল্যের জৈব পণ্যের চাহিদা পূরণ করতে স্থানীয় এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। তাঁর সাফল্য অন্য কৃষকদের জন্য প্রেরণা হয়ে উঠেছে।
২. বিশ্বনাথ: মহারাষ্ট্রে এক একরে ৭ লক্ষ টাকার আয়
মহারাষ্ট্রের বিড জেলার খরাপ্রবণ এলাকায় বিশ্বনাথ এক একর জমিতে বছরে ৭ লক্ষ টাকার আয় করছেন। তিনি মাল্টি-ক্রপিং পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন এবং তার জমির চারপাশে তারের বেড়া দিয়ে ক্লাইম্বার গাছ লাগিয়েছেন। প্রথম বছরের লাভ দিয়ে তিনি স্প্রিংকলার সেচ ব্যবস্থা স্থাপন করেন। তিনি উত্থিত বেড কৃষি এবং মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করেন, যা শ্রম ও খরচ কমিয়েছে। তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে মিলে তিনি কেবল দুজন শ্রমিকের সাহায্যে জমি পরিচালনা করেন।
৩. প্রমোদ: প্রকৌশলী থেকে কৃষক
প্রমোদ, একজন প্রাক্তন অটোমোবাইল প্রকৌশলী, ২০০৬ সালে কৃষিতে প্রবেশ করেন এবং এখন বছরে এক কোটি টাকার টার্নওভার করছেন। তিনি উদ্ভাবনী চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে উচ্চ ফলনশীল ফসল উৎপাদন করেন। তাঁর সাফল্য প্রমাণ করে যে শিক্ষিত তরুণরাও কৃষিতে সাফল্য অর্জন করতে পারেন।
৪. প্রিন্স শুক্লা: বিহারের এগ্রি-স্টার্টআপ
বিহারের ২৪ বছর বয়সী প্রিন্স শুক্লা কোভিড মহামারীর সময় বিদেশে পড়াশোনার স্বপ্ন ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন। মাত্র ১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করে তিনি ‘এগ্রেট’ নামে একটি এগ্রি-স্টার্টআপ শুরু করেন, যা ১০,০০০ কৃষককে সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ, এবং প্রযুক্তি সরবরাহ করে। তাঁর স্টার্টআপ এখন আইটিসি, পার্লে-র মতো বড় কোম্পানির সঙ্গে কাজ করে এবং ২.৫ কোটি টাকার টার্নওভার অর্জন করেছে।
৫. হাইড্রোপনিক্স এবং মাশরুম চাষ: বেঙ্গালুরু ও পুনে
বেঙ্গালুরু এবং পুনে শহরে হাইড্রোপনিক্স এবং মাশরুম চাষ লাভজনক হয়ে উঠেছে। হাইড্রোপনিক্সে মাটি ছাড়াই পুষ্টিসমৃদ্ধ জলে ফসল উৎপাদন করা হয়, যা উচ্চ ফলন এবং কম জমির প্রয়োজন হয়। মাশরুম চাষে বিনিয়োগ কম এবং বাজারে চাহিদা বেশি। উদাহরণস্বরূপ, এক হেক্টর জমিতে সবজি চাষে ৬০,০০০ থেকে ১ লক্ষ টাকা লাভ সম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিকে লাভজনক করতে হলে কয়েকটি মূল কৌশল অবলম্বন করতে হবে:
১. প্রযুক্তির ব্যবহার: ড্রোন, সেন্সর, এবং ফার্ম ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারের মতো প্রযুক্তি ফসল পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনাকে আরও দক্ষ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, নির্ভুল কৃষি (precision agriculture) ফলন ১৫-৪০% বাড়াতে পারে।
২. জৈব কৃষি ও উচ্চ মূল্যের ফসল: জৈব ফল, সবজি, এবং মশলা (যেমন জাফরান, আদা) উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়। ভারতে জৈব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক।
৩. বাজার সংযোগ: কৃষক উৎপাদক সংগঠন (FPO) এবং সমবায় সমিতির মাধ্যমে কৃষকরা মধ্যস্থতাকারীদের এড়িয়ে সরাসরি বাজারে পণ্য বিক্রি করতে পারেন। এটি লাভের পরিমাণ বাড়ায়।
৪. সরকারি সহায়তা: সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প, যেমন প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চাই যোজনা, পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা (PKVY), এবং কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (KCC), কৃষকদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে।
৫. ফসল বৈচিত্র্যকরণ: উচ্চ মূল্যের ফসল যেমন জাফরান (৩,৫০০-৫,০০০ ডলার/কেজি), আদা (৬-৮ ডলার/কেজি), এবং ড্রাগন ফ্রুট (৩-৭ ডলার/ফল) চাষ লাভজনক।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
কৃষি খাতে চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে অপর্যাপ্ত সেচ, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং বাজার অবকাঠামোর অভাব। বিশ্বব্যাংকের মতে, ভারতের ৬৩% কৃষিজমি বৃষ্টিনির্ভর, যা উৎপাদনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে। এছাড়া, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার ভূমির উর্বরতা হ্রাস করছে। সমাধান হিসেবে, ড্রিপ সেচ, জৈব সার, এবং উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহার করা যেতে পারে।
সরকারি নীতিগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৫-২৬ সালে কৃষি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ২২-২৫ লক্ষ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা কৃষকদের আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করবে। এছাড়া, ১০,০০০ নতুন FPO গঠন এবং ১,৪৬৯ শস্য সংরক্ষণ ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা কৃষকদের বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াবে।
কৃষি লাভজনক হতে পারে—এটি প্রমাণ করেছেন রমেশ চন্দ্র দাগর, বিশ্বনাথ, এবং প্রিন্স শুক্লার মতো কৃষক এবং উদ্যোক্তারা। প্রযুক্তি, জৈব কৃষি, ফসল বৈচিত্র্যকরণ, এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে কৃষকরা তাঁদের আয় বাড়াতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষিকে লাভজনক করতে হলে কৃষকদের উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে এবং সরকারকে অবকাঠামো, ঋণ, এবং বাজার সংযোগের ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় হতে হবে। ভারতের কৃষি খাতের সম্ভাবনা অপরিসীম, এবং সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এটি আবার লাভজনক হতে পারে।