দেশের কৃষি খাতের টেকসই ও সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বুধবার তিনটি নতুন ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ‘প্রধানমন্ত্রী ধন-ধান্য কৃষি যোজনা’ (PM Dhan-Dhaanya Krishi Yojana), যা ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে প্রথম ঘোষণা করা হয়। এই প্রকল্পের বার্ষিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৪,০০০ কোটি টাকা। আগামী ছয় বছরে এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১.৭ কোটি কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো দেশের ১০০টি কৃষি-কেন্দ্রিক জেলাকে টার্গেট করে সমন্বিতভাবে কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটানো। কেন্দ্রের ১১টি মন্ত্রকের অধীনে থাকা ৩৬টি বিদ্যমান স্কিমকে একত্রিত করে এই বিশেষ যোজনাটি বাস্তবায়ন করা হবে। এই ১০০টি জেলা নির্বাচন করা হয়েছে কৃষি উৎপাদনশীলতা কম, ফসল ঘনত্ব মাঝারি এবং কৃষি ঋণের সুবিধা সীমিত — এই তিনটি প্রধান সূচক বিবেচনা করে। প্রতিটি রাজ্য থেকে অন্তত একটি জেলা এই প্রকল্পের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব।
প্রকল্পের ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘‘এই যোজনার মূল উদ্দেশ্য হলো জেলা স্তরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টা একত্রিত করা এবং কৃষিক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে চালু হওয়া অ্যাসপিরেশনাল ডিস্ট্রিক্টস প্রোগ্রামের মতো এই প্রকল্পও সমন্বয় এবং সম্মিলিত পদক্ষেপের উপর জোর দিচ্ছে।’’
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
প্রধানমন্ত্রী ধন-ধান্য কৃষি যোজনার প্রধান লক্ষ্যগুলো হলো:
- কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: উন্নত বীজ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানসম্মত চাষপদ্ধতির মাধ্যমে জেলাগুলোতে ফসল উৎপাদন বাড়ানো হবে।
- ফসলের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি: একটিমাত্র ফসলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য লাভজনক ও পুষ্টিকর ফসল চাষে উৎসাহ দেওয়া হবে।
- টেকসই কৃষি অনুশীলন: রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস করে জৈব ও প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষকে উৎসাহিত করা হবে।
- সেচব্যবস্থা সম্প্রসারণ: নতুন সেচ প্রকল্প ও মাইক্রো-ইরিগেশন পদ্ধতির মাধ্যমে জলের সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হবে, যাতে খরার সময়েও চাষের ক্ষতি কমানো যায়।
- উত্তর-ফসল ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ অবকাঠামো: ফসল কাটা পরবর্তী সময়ে ক্ষতি কমাতে আধুনিক গুদামঘর, শীতলীকরণ কেন্দ্র ও প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন করা হবে।
- কৃষি ঋণ ও অর্থায়নের সহজলভ্যতা: স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুবিধা বাড়ানো হবে, যাতে কৃষকেরা সময়মতো পুঁজি সংগ্রহ করতে পারেন।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকরা শুধুমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধিতেই নয়, বরং বাজারে ভালো দামে ফসল বিক্রি করতে পারবেন এবং মুনাফা বাড়াতে সক্ষম হবেন। এর পাশাপাশি কৃষি অবকাঠামোর উন্নতি কৃষিজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সম্পৃক্ত মন্ত্রক ও সংস্থার ভূমিকা:
প্রকল্পের সফল বাস্তবায়নের জন্য কৃষি মন্ত্রকের পাশাপাশি জলসম্পদ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, অর্থ, রুরাল ডেভেলপমেন্ট, সড়ক পরিবহন ও অন্যান্য মন্ত্রক একসাথে কাজ করবে। প্রতিটি জেলা পর্যায়ে একাধিক মন্ত্রকের কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি ‘জেলা স্টিয়ারিং কমিটি’ গঠন করা হবে। এই কমিটি প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি তদারকি করবে এবং কৃষকদের সমস্যার দ্রুত সমাধান নিশ্চিত করবে।
কৃষকদের প্রতিক্রিয়া:
প্রকল্পটি ঘোষণার পর বিভিন্ন কৃষক সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। অনেকেই মনে করছেন, কৃষি খাতকে জেলাভিত্তিকভাবে উন্নয়নের এই উদ্যোগ দেশের সামগ্রিক কৃষি অর্থনীতিকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে। বিশেষ করে সেচব্যবস্থা এবং ফসল সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ কৃষকের আয়ের স্থায়িত্ব বাড়াতে সহায়ক হবে।
মহারাষ্ট্রের নাসিকের আঙুর চাষি বিজয় পাটিল বলেন, ‘‘আমরা অনেক বছর ধরে আধুনিক সেচ পদ্ধতি এবং ভাল মানের গুদামের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সঠিক অবকাঠামো পেলে আমাদের লাভ বহুগুণ বাড়বে।’’
সরকারের প্রত্যাশা:
সরকারের আশা, এই প্রকল্পের মাধ্যমে আগামী ছয় বছরে দেশের কৃষি জিডিপি-তে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব হবে। কৃষকের আয় দ্বিগুণের লক্ষ্যে এটি আরেকটি বড় ধাপ।
মোট কথা, প্রধানমন্ত্রী ধন-ধান্য কৃষি যোজনা দেশের কৃষি-নির্ভর অর্থনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সঠিকভাবে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের কৃষক সমাজের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।