বাংলার পানের পাতার রপ্তানি বাজারে উত্থান! ২০০ কোটি টাকার সুযোগ?

পশ্চিমবঙ্গের পানের পাতা (Betel Leaf Farming Bengal), যাকে ‘সবুজ সোনা’ বলা হয়, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। পানের পাতার রপ্তানি বাজার গত কয়েক…

Bengal’s Betel Leaf Export Market Booms: A ₹200 Crore Opportunity for Farmers

পশ্চিমবঙ্গের পানের পাতা (Betel Leaf Farming Bengal), যাকে ‘সবুজ সোনা’ বলা হয়, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। পানের পাতার রপ্তানি বাজার গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং এটি এখন প্রায় ২০০ কোটি টাকার একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলি এই রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই প্রতিবেদনে আমরা পানের পাতার চাষ, রপ্তানির সম্ভাবনা, এবং চ্যালেঞ্জগুলির উপর আলোকপাত করব।

পানের পাতার চাষ: একটি ঐতিহ্যবাহী পেশা
পানের পাতা, যা বৈজ্ঞানিকভাবে Piper betle নামে পরিচিত, ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগদ ফসল। পশ্চিমবঙ্গে এটি প্রায় ২০,০০০ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়, যা দেশের মোট পান উৎপাদনের প্রায় ৬৬% অবদান রাখে। এই ফসলটি প্রায় ৪-৫ লক্ষ কৃষক পরিবারের জীবিকার উৎস। পানের পাতা শুধুমাত্র মুখরোচক হিসেবে নয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানেও ব্যবহৃত হয়। ভারতে প্রায় ১৫-২০ মিলিয়ন মানুষ পানের পাতা ভক্ষণ করে, এবং এটি প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে।

   

পশ্চিমবঙ্গে পানের চাষ বাণিজ্যিকভাবে বিশেষত নদিয়া, বাঁকুড়া, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলায় ব্যাপক। এই অঞ্চলগুলির উর্বর মাটি এবং আর্দ্র জলবায়ু পান চাষের জন্য উপযুক্ত। তবে, এই ফসলটি আবহাওয়ার পরিবর্তনের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল, এবং অতিরিক্ত গরম বা শুষ্ক বাতাস পাতার গুণমান ও ফলনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

Bengal’s Betel Leaf Export Market Booms: A ₹200 Crore Opportunity for Farmers
Bengal’s Betel Leaf Export Market Booms: A ₹200 Crore Opportunity for Farmers

রপ্তানি বাজার: একটি উদীয়মান সম্ভাবনা
ভারত পানের পাতার একটি প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। ২০২৩-২৪ সালে ভারত ১,৬২০.০৬ মেট্রিক টন পানের পাতা রপ্তানি করেছে, যার মূল্য ছিল প্রায় ৫.১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পশ্চিমবঙ্গ এই রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশে অবদান রাখে। প্রধান রপ্তানি গন্তব্যগুলির মধ্যে রয়েছে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০২৩ সালে একটি নতুন নীতি ঘোষণা করে, যার মাধ্যমে জমির মালিকানা ছাড়া পান চাষীদেরও রপ্তানির জন্য নিবন্ধন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই নীতি অনুযায়ী, ভূমিহীন কৃষকরা জমির মালিকের সম্মতিপত্র সহ তাদের খামার নিবন্ধন করতে পারেন। এই পদক্ষেপের ফলে নদিয়ার মতো জেলায় শত শত ভূমিহীন কৃষক রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করেছে। ফলস্বরূপ, রপ্তানির পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০২১ সালে শেল্যাক অ্যান্ড ফরেস্ট প্রোডাক্টস এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিল (Shefexil)-এর অধীনে রপ্তানির জন্য স্বাস্থ্য শংসাপত্র প্রদানের দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকে পানের পাতার রপ্তানি আরও নিরাপদ ও সুগম হয়েছে। এর আগে সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার কারণে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। Shefexil কৃষকদের শিক্ষিত করা এবং হায়দ্রাবাদে স্বাস্থ্য শংসাপত্রের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করে এই সমস্যার সমাধান করেছে।

২০০ কোটি টাকার সুযোগ
পানের পাতার রপ্তানি বাজারের বর্তমান মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা, তবে এটি আগামী দুই বছরে ২০০ কোটি টাকায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনার পিছনে রয়েছে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাহিদা, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে। পানের পাতা মুখরোচক হিসেবে ছাড়াও ঔষধি ও প্রসাধনী পণ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা এর চাহিদা বাড়িয়েছে।

Advertisements

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা স্থানীয় বাজারের তুলনায় রপ্তানির জন্য বেশি দাম পান। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় বাজারে একটি পানের পাতার বান্ডিল (১২,০০০ পাতা) ২,৫০০ থেকে ৫,০০০ টাকায় বিক্রি হয়, কিন্তু রপ্তানির ক্ষেত্রে এটি ১৪,০০০ টাকা পর্যন্ত দাম পায়। এই দামের পার্থক্য কৃষকদের জন্য একটি বড় প্রণোদনা।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
পানের পাতার চাষ ও রপ্তানির পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, পানের পাতা অত্যন্ত পচনশীল, যা পরিবহন এবং সংরক্ষণকে জটিল করে তোলে। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং তাপমাত্রার ওঠানামা পানের ফলন ও গুণমানের উপর প্রভাব ফেলছে। ২০০৯ সালের আইলা ঘূর্ণিঝড় এবং ২০২১ সালের ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ পশ্চিমবঙ্গের পান চাষীদের ব্যাপক ক্ষতির মুখে ফেলেছে।

এছাড়া, শ্রমিকের ঘাটতি, উচ্চ শ্রম খরচ, এবং কীটপতঙ্গ ও রোগের সমস্যা পান চাষের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। বাঁকুড়া জেলায় পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পান চাষের ব্যয়-আয় অনুপাত ২.৩, যা এটিকে একটি লাভজনক ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তবে, বোরোজ (পানের বাগান) তৈরির উচ্চ খরচ এবং বাজারে দামের ওঠানামা কৃষকদের জন্য চ্যালেঞ্জ।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই সমস্যাগুলি মোকাবেলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ভূমিহীন কৃষকদের জন্য রপ্তানি নিবন্ধনের সুযোগ ছাড়াও, সরকার আধুনিক চাষ পদ্ধতি এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহারে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এছাড়া, রপ্তানির জন্য পানের পাতার গুণমান নিশ্চিত করতে পরীক্ষাগার স্থাপন এবং স্বাস্থ্য শংসাপত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পানের পাতার রপ্তানি বাজারে পশ্চিমবঙ্গের সম্ভাবনা অপার। আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, কৃষকদের জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ। তবে, এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে কয়েকটি বিষয়ে জোর দেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, রপ্তানির জন্য উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা এবং কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় রোগ প্রতিরোধী জাত এবং আধুনিক চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, রপ্তানি পণ্যের উপর ১৮% জিএসটি কমানোর দাবি উঠেছে, কারণ বাংলাদেশের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে এই ধরনের কর নেই, যা তাদের পণ্যকে সস্তা করে।

পশ্চিমবঙ্গের পানের পাতার রপ্তানি বাজার একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে উঠে আসছে। ২০০ কোটি টাকার বাজার মূল্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, বরং লক্ষ লক্ষ কৃষক পরিবারের জীবিকার উন্নতিও নিশ্চিত করবে। সরকারি উদ্যোগ, কৃষকদের প্রশিক্ষণ, এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেবে। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন, শ্রমিকের ঘাটতি, এবং বাজারের ওঠানামার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের পান চাষীরা এই ‘সবুজ সোনা’র মাধ্যমে বিশ্ব বাজারে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে।