বাংলার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেন মিশ্র চাষের প্রচার করছে?

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। এই রাজ্যের ৮% জনগণ কৃষি ও সম্পর্কিত কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত, এবং এটি ভারতের মোট জুট উৎপাদনের ৬৬% এবং…

Bengal’s Agricultural Universities Push Mixed Farming for Sustainable Growth and Farmer Prosperity Mixed Farming, Bengal Agriculture, Agricultural Universities, Sustainable Farming

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতি দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। এই রাজ্যের ৮% জনগণ কৃষি ও সম্পর্কিত কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত, এবং এটি ভারতের মোট জুট উৎপাদনের ৬৬% এবং ধানের ১৫% সরবরাহ করে। তবে, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং মাটির উর্বরতা হ্রাসের মতো চ্যালেঞ্জের মুখে, বাংলার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মিশ্র চাষ (Mixed Farming) প্রচারের দিকে মনোনিবেশ করছে। এই পদ্ধতি কৃষকদের জন্য আয়ের বৈচিত্র্য, মাটির স্বাস্থ্য উন্নতি, এবং টেকসই কৃষির পথ প্রশস্ত করছে। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (NBAU), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি এই উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

মিশ্র চাষ কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
মিশ্র চাষ হল এমন একটি কৃষি পদ্ধতি যেখানে একই জমিতে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি পশুপালন, মৎস্য চাষ, মৌমাছি পালন, এবং অন্যান্য কৃষি-সম্পর্কিত কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হল সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা, এবং কৃষকদের জন্য একাধিক আয়ের উৎস তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার বানমালী দাস নামে এক কৃষক তাঁর ০.২৫ একর জমিতে ধানের পাশাপাশি মাছ চাষ, হাঁস পালন, এবং সবজি চাষ করছেন। তিনি জৈব সার হিসেবে গোবর এবং ফসলের অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করেন, যা তাঁর জমির উর্বরতা বাড়িয়েছে এবং রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমিয়েছে।

   

বাংলার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এই পদ্ধতিকে প্রচার করছে কারণ এটি কৃষকদের ঝুঁকি কমায় এবং আয়ের স্থিতিশীলতা প্রদান করে। একক ফসল চাষে বাজারের অস্থিরতা, জলবায়ু পরিবর্তন, বা ফসলের রোগের কারণে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু মিশ্র চাষে, যদি একটি ফসল ব্যর্থ হয়, তবে পশুপালন বা মৎস্য চাষ থেকে আয় ক্ষতিপূরণ করতে পারে। এছাড়া, এই পদ্ধতি মাটির পুষ্টি চক্রকে উন্নত করে এবং রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে পরিবেশের ক্ষতি কমায়।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মিশ্র চাষের প্রচারে গবেষণা, প্রশিক্ষণ, এবং কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (NBAU) ২০১৪ সাল থেকে অলিপুরদুয়ারের উত্তর চকোয়াখেতি গ্রামে একটি প্রকল্পে কাজ করছে, যেখানে কৃষকদের মিশ্র চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পে ধান, সবজি, এবং মাছ চাষের সমন্বয়ের মাধ্যমে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তরবঙ্গের মতো অঞ্চলে, যেখানে ধান, ভুট্টা, এবং তৈলবীজের চাষ প্রচলিত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কৃষকদের নতুন হাইব্রিড জাত এবং জৈব সারের ব্যবহার শিখিয়েছে।

Bengal’s Agricultural Universities Push Mixed Farming for Sustainable Growth and Farmer Prosperity Mixed Farming, Bengal Agriculture, Agricultural Universities, Sustainable Farming
Bengal’s Agricultural Universities Push Mixed Farming for Sustainable Growth and Farmer Prosperity

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগও শান্তিনিকেতনে টেকসই কৃষি পদ্ধতির উপর গবেষণা চালাচ্ছে। তারা কৃষকদের মধ্যে জৈব চাষ এবং ফসলের বৈচিত্র্যকরণের উপর জোর দিচ্ছে। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় পশুপালন এবং মৎস্য চাষকে ফসল উৎপাদনের সঙ্গে একীভূত করার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রদর্শনী খামার রয়েছে, যেখানে কৃষকরা আধুনিক পশুপালন এবং মাছ চাষের কৌশল শিখতে পারেন।

মিশ্র চাষের সুবিধা
মিশ্র চাষের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যা বাংলার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় করছে। প্রথমত, এটি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে। উদাহরণস্বরূপ, পশুর গোবর জৈব সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়, এবং ফসলের অবশিষ্টাংশ পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। দ্বিতীয়ত, এটি কৃষকদের আয়ের বৈচিত্র্য আনে। মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়া জেলার কৃষকরা গমের পরিবর্তে কলা, ডাল, এবং ভুট্টা চাষ শুরু করেছেন, যা তাদের আয় বাড়িয়েছে। তৃতীয়ত, মিশ্র চাষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়ক। ধান-মাছ-হাঁসের মতো সমন্বিত চাষ পদ্ধতি জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং পানির ব্যবহার কমায়।

Advertisements

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
মিশ্র চাষের সুবিধা থাকলেও, এর কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বাংলার ৯৬% কৃষক ছোট ও প্রান্তিক, এবং তাদের গড় জমির আয়তন মাত্র ০.৭৭ হেক্টর। এই কারণে, মিশ্র চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি এবং প্রযুক্তির অভাব একটি বড় সমস্যা। এছাড়া, বাজারের অস্থিরতা এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণের অভাবও বাধা সৃষ্টি করে। তবে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি এই সমস্যার সমাধানে কাজ করছে। তারা কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা, জৈব সার ও বীজ সরবরাহ, এবং কৃষি ঋণের সুবিধা প্রদান করছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারও এই উদ্যোগে সহায়তা করছে। কৃষক বাজার (Krishak Bazar) এবং ই-নাম (e-NAM) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন। এছাড়া, সরকার নতুন হাইব্রিড জাত এবং জলবায়ু-সহিষ্ণু ফসলের প্রচার করছে, যা মিশ্র চাষের সাফল্য বাড়াচ্ছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মিশ্র চাষের মাধ্যমে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এই পদ্ধতি শুধু অর্থনৈতিক সুবিধাই দেয় না, বরং পরিবেশগত টেকসইতা নিশ্চিত করে। জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির ক্ষয়, এবং জনসংখ্যার চাপের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মিশ্র চাষ একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি কৃষকদের নতুন প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের সঙ্গে সংযুক্ত করছে, যা বাংলার কৃষি অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।

বাংলার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির এই প্রচেষ্টা শুধু কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে না, বরং রাজ্যের কৃষি খাতকে টেকসই এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মিশ্র চাষের মাধ্যমে, বাংলা তার কৃষি ঐতিহ্যকে ধরে রেখে আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পথে এগিয়ে চলেছে।