পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে জিরো বাজেট প্রাকৃতিক কৃষি (Zero Budget Natural Farming- ZBNF) একটি নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছে। এই কৃষি পদ্ধতি, যা রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই কৃষিকাজের উপর জোর দেয়, কৃষকদের জন্য কম খরচে উচ্চ ফলন এবং টেকসই কৃষির পথ দেখিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি গ্রামে, যেমন বীরভূম, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার মতো অঞ্চলে, এই পদ্ধতি গ্রহণ করা কৃষকরা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা এমন একটি গ্রামের গল্প তুলে ধরব, যেখানে জিরো বাজেট প্রাকৃতিক কৃষি কৃষকদের জীবন বদলে দিয়েছে, তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং পরিবেশগত স্থায়িত্ব এনে দিয়েছে।
জিরো বাজেট প্রাকৃতিক কৃষি কী?
জিরো বাজেট প্রাকৃতিক কৃষি (ZBNF) হল এমন একটি কৃষি পদ্ধতি, যেখানে কৃষকরা কোনো বাহ্যিক রাসায়নিক সার বা কীটনাশক ব্যবহার না করে স্থানীয় সম্পদ, যেমন গোবর, গোমূত্র, এবং জৈব পদার্থ ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করেন। এই পদ্ধতির মূল লক্ষ্য হল কৃষির খরচ শূন্যের কাছাকাছি রাখা এবং মাটির উর্বরতা বজায় রাখা। মহারাষ্ট্রের কৃষিবিদ সুভাষ পালেকর এই পদ্ধতির প্রবক্তা, যিনি ১৯৯০-এর দশকে এটি প্রবর্তন করেন। পশ্চিমবঙ্গে এই পদ্ধতি গ্রহণকারী কৃষকরা দেখিয়েছেন যে, সঠিক পরিকল্পনা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এটি কৃষির জন্য একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ হতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গে ZBNF-এর সাফল্যের গল্প
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার একটি ছোট গ্রাম, বলরামপুরে, কৃষকরা জিরো বাজেট প্রাকৃতিক কৃষি গ্রহণ করে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছেন। এই গ্রামের কৃষক শ্যামল মণ্ডল* (নাম পরিবর্তিত) তার ২ একর জমিতে ZBNF পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করেন ২০২০ সালে। তিনি গানাজীবামৃত এবং দ্রবজীবামৃত তৈরি করে তার ধান, গম, এবং বিভিন্ন শাকসবজির চাষ শুরু করেন। প্রথম সাত মাসের মধ্যে তিনি লক্ষ্য করেন যে তার ফসলের গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ফলন আগের তুলনায় ২০% বেশি হয়েছে। তিনি বাজারে তার জৈব পণ্যের জন্য উচ্চ মূল্য পেয়েছেন, যা তার আয় বাড়িয়েছে। শ্যামলের সাফল্য অন্যান্য গ্রামবাসীদের অনুপ্রাণিত করেছে, এবং এখন গ্রামের প্রায় ৫০টি পরিবার এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।
একইভাবে, বাঁকুড়া জেলার আরেকটি গ্রামে, কৃষক সুমিতা মাহাতো* তার ১.৫ একর জমিতে মিশ্র ফসল চাষ (ইন্টারক্রপিং) এবং ZBNF পদ্ধতি ব্যবহার করে ডাল, মিলেট, এবং সবজি চাষ করছেন। তিনি বীজামৃত দিয়ে বীজ প্রক্রিয়াকরণ করেন এবং শুকনো পাতা দিয়ে মালচিং করেন। ফলস্বরূপ, তার জমির মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং তিনি কম জল ব্যবহার করে বেশি ফলন অর্জন করেছেন। সুমিতার মতে, “এই পদ্ধতি আমার কৃষি খরচ প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনেছে, এবং আমার ফসল এখন বাজারে বেশি দামে বিক্রি হয়।” তিনি এখন স্থানীয় মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর (SHG) সঙ্গে যুক্ত হয়ে অন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
ZBNF-এর সুবিধা
জিরো বাজেট প্রাকৃতিক কৃষি কৃষকদের জন্য একাধিক সুবিধা নিয়ে আসে। প্রথমত, এটি কৃষির খরচ কমায়। রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে পাওয়া গোবর, গোমূত্র, এবং জৈব পদার্থ ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয়ত, এটি মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে। গানাজীবামৃত এবং দ্রবজীবামৃতের মতো জৈব সার মাটির জীবাণু এবং কেঁচোর কার্যকলাপ বাড়ায়, যা মাটির উর্বরতা বজায় রাখে। তৃতীয়ত, এই পদ্ধতি জলের ব্যবহার ৫০-৬০% কমায়, যা পশ্চিমবঙ্গের শুষ্ক অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
এছাড়া, ZBNF মিশ্র ফসল চাষের উপর জোর দেয়, যা কৃষকদের একই জমিতে একাধিক ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম করে। এটি আয়ের বৈচিত্র্য আনে এবং বাজারের ঝুঁকি কমায়। উদাহরণস্বরূপ, বলরামপুর গ্রামের কৃষকরা ধানের পাশাপাশি মিলেট, ডাল, এবং শাকসবজি চাষ করছেন, যা তাদের আয় বাড়িয়েছে। এই পদ্ধতি পরিবেশের উপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, কারণ এটি রাসায়নিক দূষণ এবং মাটির ক্ষয় কমায়।
সরকারি ও সম্প্রদায়ের ভূমিকা
পশ্চিমবঙ্গে ZBNF-এর প্রসারে স্থানীয় স্বনির্ভর গোষ্ঠী (SHG) এবং কৃষি বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্থানীয় এনজিও এবং কৃষি বিশেষজ্ঞরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, যাতে তারা গানাজীবামৃত, দ্রবজীবামৃত, এবং নিমাস্ত্রের মতো জৈব সার এবং কীটনাশক তৈরি করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও রাষ্ট্রীয় কৃষি উন্নয়ন যোজনা এবং পরম্পরাগত কৃষি উন্নয়ন যোজনার মাধ্যমে জৈব কৃষির জন্য ভর্তুকি ও প্রশিক্ষণ প্রদান করছে।
বীরভূমের বলরামপুর গ্রামে একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করা হয়েছে, যেখানে কৃষকরা নিয়মিত সভা করে তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। এই গোষ্ঠীগুলি কৃষকদের মধ্যে জ্ঞানের আদান-প্রদান এবং সম্প্রদায়ের সমর্থন বাড়ায়। এছাড়া, স্থানীয় বাজারে জৈব পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে কৃষকরা তাদের পণ্যের জন্য উচ্চ মূল্য পাচ্ছেন। কিছু কৃষক কলকাতার মতো শহরে তাদের পণ্য সরবরাহ করার জন্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
ZBNF গ্রহণে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, রাসায়নিক কৃষি থেকে জৈব কৃষিতে রূপান্তরে ২-৩ বছর সময় লাগতে পারে, যা কিছু কৃষকের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা। দ্বিতীয়ত, জৈব পণ্যের জন্য স্থানীয় বাজারের অভাব একটি সমস্যা। তবে, স্থানীয় এনজিও এবং সরকারি উদ্যোগ এই সমস্যার সমাধানে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষকদের জন্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং সরাসরি বাজার সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে।
এছাড়া, প্রশিক্ষণ এবং জ্ঞানের অভাব কিছু কৃষকের জন্য বাধা। তবে, সুভাষ পালেকরের নেতৃত্বে এবং স্থানীয় কৃষি বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে নিয়মিত কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণ ক্যাম্প এই সমস্যা সমাধানে সহায়ক। পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা এখন এই পদ্ধতির সুবিধা সম্পর্কে আরও সচেতন হচ্ছেন।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
জিরো বাজেট প্রাকৃতিক কৃষি পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি টেকসই এবং লাভজনক বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এটি কেবল কৃষকদের আর্থিক স্বাধীনতাই নিশ্চিত করছে না, বরং পরিবেশ সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবদান রাখছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি এই পদ্ধতির প্রসারে আরও বিনিয়োগ করে এবং কৃষকদের জন্য বাজার সংযোগ স্থাপন করে, তবে এটি রাজ্যের কৃষি খাতে একটি নতুন বিপ্লব আনতে পারে।
বলরামপুরের মতো গ্রামগুলি প্রমাণ করছে যে, জিরো বাজেট প্রাকৃতিক কৃষি কেবল একটি কৃষি পদ্ধতি নয়, বরং একটি জীবনধারা, যা কৃষকদের স্বনির্ভরতা এবং পরিবেশের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রাখতে শেখায়। এই গ্রামের কৃষকদের সাফল্যের গল্প অন্যান্য গ্রামের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে।