পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষীরা ক্রমবর্ধমান ফিডের দামের সঙ্গে লড়াই করছেন

পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষ শিল্প যা রাজ্যের অর্থনীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এখন একটি নতুন সংকটের মুখোমুখি। ২০২৫ সালে মাছের ফিডের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায়…

Bengal Fish Farmers Battle Soaring Feed Prices in 2025: Challenges and Solutions for Aquaculture

পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষ শিল্প যা রাজ্যের অর্থনীতি এবং খাদ্য নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এখন একটি নতুন সংকটের মুখোমুখি। ২০২৫ সালে মাছের ফিডের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় মৎস্যচাষীরা (Bengal Fish Farmers) তাদের লাভের মার্জিন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ, যা ভারতের অন্যতম শীর্ষ মৎস্য উৎপাদক রাজ্য, এখানে মৎস্যচাষীরা রুই, কাতলা, তেলাপিয়া এবং ভানামি চিংড়ির মতো মাছের চাষের জন্য উচ্চমানের ফিডের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, আমদানি নির্ভরতা এবং জ্বালানি খরচের বৃদ্ধির কারণে ফিডের দাম ২০২৪-এর তুলনায় ১৫-২০% বেড়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষীদের এই চ্যালেঞ্জ, তাদের প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।

মৎস্যচাষে ফিডের গুরুত্ব এবং দাম বৃদ্ধির প্রভাব
মৎস্যচাষে ফিড সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা মাছের বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতা নির্ধারণ করে। পশ্চিমবঙ্গে মৎস্যচাষীরা সাধারণত বাণিজ্যিক ফিড ব্যবহার করে, যা সয়াবিন, ভুট্টা, মাছের গুঁড়া, ধানের কুঁড়া এবং বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ দিয়ে তৈরি। ২০২৫ সালে ফিডের দাম প্রতি কেজিতে ৬০-১০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে, যা গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। উদাহরণস্বরূপ, ফ্লোটিং ফিডের দাম এখন ৬০-৭০ টাকা/কেজি এবং সুপার-ফ্লোটিং ফিডের দাম ৮০-১০০ টাকা/কেজি। এই দাম বৃদ্ধির পেছনে প্রধান কারণ হল কাঁচামালের আমদানি খরচ বৃদ্ধি, জ্বালানি দামের ঊর্ধ্বগতি এবং বিশ্ববাজারে সয়াবিন ও ভুট্টার দামের ওঠানামা।

   

পূর্ব মেদিনীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এবং হাওড়ার মতো জেলাগুলিতে মৎস্যচাষীরা জানিয়েছেন যে ফিডের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন খরচ ২৫-৩০% বেড়েছে। এই অতিরিক্ত খরচ তাদের লাভের মার্জিন কমিয়ে দিচ্ছে এবং অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষী ঋণের জালে আটকে যাচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব মেদিনীপুরের বাগুরান জলপাই গ্রামের কৃষক রবীন্দ্রনাথ ভুইয়া বলেন, “আমি চিংড়ি চাষে ভালো লাভ করতাম, কিন্তু ফিডের দাম বাড়ায় এখন বিনিয়োগ ফেরত পাওয়াও কঠিন।”

দাম বৃদ্ধির কারণ
ফিডের দাম বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, ভারত মাছের ফিডের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৪৫-৫০% আমদানি করে, যেমন সয়াবিন, মাছের গুঁড়া এবং ভিটামিন প্রিমিক্স। বিশ্ববাজারে এই উপাদানগুলির দাম ২০২৪-এর তুলনায় ২০-৩০% বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, জ্বালানি দামের বৃদ্ধি ফিড উৎপাদন এবং পরিবহন খরচ বাড়িয়েছে। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনের মতো উপকূলীয় অঞ্চলে ঘন ঘন ঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং বন্যা মৎস্যচাষের উৎপাদনশীলতা কমিয়েছে, যা চাষীদের উপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।

এছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গে মাছের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফিডের চাহিদাও বেড়েছে। ২০২৩ সালে রাজ্যে মাছের উৎপাদন ২০.৪৫ লক্ষ টন ছিল, যা ২০২২ সালের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এই উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উচ্চমানের ফিডের প্রয়োজন, যা এখন ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।

Bengal Fish Farmers Battle Soaring Feed Prices in 2025: Challenges and Solutions for Aquaculture
Bengal Fish Farmers Battle Soaring Feed Prices in 2025: Challenges and Solutions for Aquaculture

চাষীদের চ্যালেঞ্জ
পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষীরা শুধু ফিডের দাম বৃদ্ধির সমস্যাই নয়, আরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রথমত, উচ্চমানের মাছের পোনার অভাব এবং বাজার অবকাঠামোর দুর্বলতা তাদের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ঋণের উপর নির্ভরতা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা শোষণ তাদের লাভ কমিয়ে দিচ্ছে। তৃতীয়ত, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন সুন্দরবনের সাইক্লোন আম্ফান (২০২০), চাষীদের মাছের স্টক ধ্বংস করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সুন্দরবনের কৃষক তুলসী হালদার বলেন, “আমি ১৬ বছর বয়স থেকে মৎস্যচাষ করছি, কিন্তু ফিডের দাম এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখন ব্যবসা চালানো কঠিন।”

এছাড়াও, অনেক চাষী ঐতিহ্যবাহী চাষ পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল, যা কম ফলনশীল। আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন কেজ কালচার বা হাইড্রোপনিক্স, গ্রহণ করার জন্য তাদের প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তার অভাব রয়েছে।

Advertisements

সমাধানের পথ
ফিডের দাম বৃদ্ধির সমস্যা মোকাবেলায় কৃষক এবং সরকার উভয়েরই সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রথমত, সরকারের উচিত কাঁচামাল আমদানির উপর শুল্ক কমানো এবং জৈব ফিড উৎপাদনের জন্য ভর্তুকি দেওয়া। দ্বিতীয়ত, স্থানীয়ভাবে ধানের কুঁড়া, ভুট্টা এবং সয়াবিনের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্প চালু করা উচিত। তৃতীয়ত, কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং কম খরচে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের আধুনিক চাষ পদ্ধতি গ্রহণে উৎসাহিত করা যেতে পারে।

এছাড়াও, কৃষকরা নিজেরাই কিছু কৌশল গ্রহণ করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, তারা স্থানীয় উপকরণ, যেমন ধানের কুঁড়া এবং গোবর, ব্যবহার করে ঘরোয়া ফিড তৈরি করতে পারেন। এটি খরচ কমাতে সাহায্য করবে। এছাড়াও, সমবায় সমিতির মাধ্যমে বাজারজাতকরণ করলে মধ্যস্বত্বভোগীদের শোষণ কমানো যাবে।

সরকারি উদ্যোগ
পশ্চিমবঙ্গ সরকার মৎস্যচাষীদের সহায়তার জন্য বেশ কিছু প্রকল্প চালু করেছে। প্রধানমন্ত্রী মৎস্য সম্পদ যোজনা এবং কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কৃষকরা ভর্তুকি এবং ঋণ পাচ্ছেন। এছাড়াও, কেজ কালচারের মতো আধুনিক পদ্ধতি প্রচারের জন্য মৎস্য বিভাগ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুরে ৮০টি কেজ স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। তবে, এই প্রকল্পগুলি এখনও বড় আকারে বাস্তবায়িত হয়নি, এবং কৃষকদের কাছে এই সুবিধা পৌঁছানোর জন্য আরও প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষ শিল্পের সম্ভাবনা অপার। রাজ্যের প্রাকৃতিক জলাশয়, উর্বর মাটি এবং বিশাল বাজার এই শিল্পের বৃদ্ধির জন্য আদর্শ। তবে, ফিডের দাম বৃদ্ধির সমস্যা সমাধান না করলে এই শিল্পের টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। সরকার, কৃষক এবং ফিড উৎপাদকদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব ফিড এবং আধুনিক চাষ পদ্ধতির ব্যবহার কৃষকদের খরচ কমাতে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে।

পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষীরা ফিডের দাম বৃদ্ধির কারণে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও, তাদের অধ্যবসায় এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সঠিক নীতি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং বাজার সংযোগের মাধ্যমে মৎস্যচাষ শিল্পকে আরও লাভজনক এবং টেকসই করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষীরা, যারা “মাছে-ভাতে বাঙালি” সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাদের এই সংকটের মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছেন।