মাশরুম চাষে বাংলার কৃষকের সাফল্য! বছরে ১৫ লাখ টাকার আয়

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষি এখনও অনেকের জীবিকার প্রধান উৎস। তবে ঐতিহ্যবাহী ফসল চাষের পাশাপাশি আধুনিক ও লাভজনক কৃষি পদ্ধতির প্রতি কৃষকদের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। এর…

Bengal Farmer’s Mushroom Farming Success: Earning ₹15 Lakh Annually with Low Investment

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষি এখনও অনেকের জীবিকার প্রধান উৎস। তবে ঐতিহ্যবাহী ফসল চাষের পাশাপাশি আধুনিক ও লাভজনক কৃষি পদ্ধতির প্রতি কৃষকদের আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। এর মধ্যে মাশরুম চাষ (Mushroom Farming ) একটি উল্লেখযোগ্য নাম হিসেবে উঠে এসেছে। কম বিনিয়োগ, স্বল্প জায়গা এবং উচ্চ লাভের সম্ভাবনার কারণে মাশরুম চাষ এখন পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এমন একজন বাংলার কৃষকের গল্প তুলে ধরব, যিনি মাশরুম চাষের মাধ্যমে বছরে ১৫ লাখ টাকার আয় করছেন।

মাশরুম চাষের আকর্ষণ
মাশরুম চাষ একটি অত্যন্ত লাভজনক কৃষি ব্যবসা, যা কম জায়গায় এবং কম বিনিয়োগে শুরু করা যায়। এটি এমন একটি ফসল, যার জন্য উর্বর মাটি বা প্রচুর সূর্যালোকের প্রয়োজন হয় না। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান, হাওড়া, মেদিনীপুর এবং দার্জিলিংয়ের মতো জেলাগুলিতে মাশরুম চাষের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়ছে। এই চাষে ব্যবহৃত কাঁচামাল যেমন গমের খড়, ধানের খড় এবং জৈব বর্জ্য সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী। মাশরুমের বাজার চাহিদাও ক্রমশ বাড়ছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং গৃহস্থালিতে।

   

পশ্চিমবঙ্গের একজন কৃষক, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, মাশরুম চাষের মাধ্যমে তার জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছেন। তিনি পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি গ্রামে বসবাস করেন এবং মাত্র ১০০০ বর্গফুট জায়গায় তার মাশরুম চাষের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। প্রাথমিক বিনিয়োগ ছিল মাত্র ২০,০০০ টাকা, যার মধ্যে তিনি মাশরুমের স্পন, কম্পোস্ট, পলিথিন ব্যাগ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম কিনেছিলেন। আজ তিনি বছরে ১৫ লাখ টাকার আয় করছেন, যা তার গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের জন্য একটি প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে।

কীভাবে শুরু হল যাত্রা?
এই কৃষকের গল্প শুরু হয়েছিল তিন বছর আগে, যখন তিনি কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের (কেভিকে) একটি মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি মাশরুম চাষের বিভিন্ন পদ্ধতি, কম্পোস্ট তৈরি, এবং স্পন উৎপাদনের প্রক্রিয়া শিখেছিলেন। প্রশিক্ষণের পর তিনি তার বাড়ির একটি ছোট ঘরে মাশরুম চাষ শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি অয়েস্টার মাশরুম চাষের উপর মনোযোগ দিয়েছিলেন, কারণ এটি তুলনামূলকভাবে সহজ এবং দ্রুত ফলন দেয়।

তার প্রথম ফসল থেকে তিনি প্রায় ৫০০ কেজি মাশরুম উৎপাদন করেন, যা তিনি স্থানীয় বাজারে কেজি প্রতি ১৫০ টাকা দরে বিক্রি করেন। এই সাফল্য তাকে আরও বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করে। তিনি তার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আরও দুটি ঘর তৈরি করেন এবং বোতাম মাশরুম এবং মিল্কি মাশরুম চাষ শুরু করেন। তিনি কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের সহায়তায় স্পন তৈরির প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন, যা তার উৎপাদন খরচ কমিয়ে দেয়।

মাশরুম চাষের সুবিধা
মাশরুম চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর স্বল্প বিনিয়োগ এবং দ্রুত ফলন। প্রতি ৪৫-৬০ দিনে একটি ফসল প্রস্তুত হয়, এবং বছরে ৫-৬টি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। এই কৃষক তার প্রথম বছরে প্রায় ৩০০০ কেজি মাশরুম উৎপাদন করেছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি প্রায় ৪.৫ লাখ টাকা আয় করেন। এরপর তিনি তার ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন এবং বর্তমানে তিনি প্রতিদিন ৫০-৬০ কেজি মাশরুম উৎপাদন করেন। গড়ে ১৫০-২০০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি করে তিনি বছরে ১৫ লাখ টাকার আয় করছেন।

মাশরুম চাষের আরেকটি সুবিধা হলো এটি পরিবেশবান্ধব। এই চাষে কৃষি বর্জ্য যেমন ধানের খড় বা গমের খড় ব্যবহার করা হয়, যা পরিবেশ দূষণ কমায়। এছাড়াও, মাশরুমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ থাকে, যা এটিকে পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে গড়ে তুলেছে। ফলে বাজারে এর চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে।

Advertisements

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
মাশরুম চাষে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। সঠিক তাপমাত্রা (২৩-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং আর্দ্রতা (৮০-৯০%) বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কৃষক প্রাথমিকভাবে এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি এয়ার কন্ডিশনার এবং হিউমিডিফায়ার ব্যবহার করে এই সমস্যার সমাধান করেন। এছাড়াও, মাশরুমের স্পনের গুণমান নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তিনি নিজেই স্পন তৈরি করতে শিখেছেন, যা তার উৎপাদন খরচ ৩০% কমিয়ে দিয়েছে।

বাজারজাতকরণও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাথমিকভাবে তিনি স্থানীয় বাজারে মাশরুম বিক্রি করতেন, কিন্তু বর্তমানে তিনি কলকাতা, দুর্গাপুর এবং শিলিগুড়ির হোটেল এবং রেস্তোরাঁগুলির সঙ্গে চুক্তি করেছেন। এছাড়াও, তিনি মাশরুমের মূল্য সংযোজন পণ্য যেমন মাশরুম পাউডার এবং পিকল তৈরি করে অতিরিক্ত আয় করছেন।

সরকারি সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার মাশরুম চাষকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প চালু করেছে। রাষ্ট্রীয় কৃষি উন্নয়ন যোজনা (আরকেভিওয়াই) এবং প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনার মাধ্যমে কৃষকরা স্বল্প সুদে ঋণ এবং ভর্তুকি পেতে পারেন। এই কৃষক প্রধানমন্ত্রী মুদ্রা যোজনার মাধ্যমে ৫ লাখ টাকার ঋণ পেয়েছিলেন, যা তিনি তার ব্যবসা সম্প্রসারণে ব্যবহার করেছেন। এছাড়াও, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং বিভিন্ন এনজিও মাশরুম চাষের প্রশিক্ষণ প্রদান করে, যা নতুন কৃষকদের জন্য সহায়ক।

সমাজ ও পরিবেশের উপর প্রভাব
এই কৃষকের সাফল্য গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের মাশরুম চাষের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। তিনি ৫০ জনেরও বেশি কৃষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তাদের স্পন সরবরাহ করছেন। এটি স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে মহিলাদের জন্য। মাশরুম চাষের মাধ্যমে কৃষি বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার হচ্ছে, যা পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়ক।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই কৃষকের লক্ষ্য তার ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারণ করা এবং মাশরুমের মূল্য সংযোজন পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো। তিনি একটি প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন, যেখানে মাশরুমের পাউডার, স্যুপ মিক্স এবং অন্যান্য পণ্য তৈরি করা হবে। এছাড়াও, তিনি আন্তর্জাতিক বাজারে মাশরুম রপ্তানির সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন। পশ্চিমবঙ্গের অনুকূল জলবায়ু এবং ক্রমবর্ধমান বাজার চাহিদার কারণে মাশরুম চাষের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

এই বাংলার কৃষকের গল্প প্রমাণ করে যে সঠিক প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কম বিনিয়োগে উচ্চ আয় সম্ভব। মাশরুম চাষ শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, বরং পরিবেশ ও সমাজের উপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই সাফল্যের গল্প অন্য কৃষকদের জন্য একটি পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবে।