ভারতের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলেও, গত কয়েক দশকে কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার (Farmer Suicide) ঘটনা একটি মর্মান্তিক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অঞ্চলগুলিতে এই সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করেছে। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৫ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ২,৯৬,৪৩৮ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, এবং ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১,০০,৪৭৪-এ পৌঁছেছে। বিদর্ভ এবং পশ্চিমবঙ্গ, দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও, কৃষক আত্মহত্যার ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ কারণ এবং পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এই নিবন্ধে আমরা বিদর্ভ এবং বাংলার কৃষি সংকটের মূল কারণ এবং কৃষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলি বিশ্লেষণ করব।
বিদর্ভের কৃষি সংকট এবং কৃষক আত্মহত্যা
বিদর্ভ, মহারাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল, তুলনামূলকভাবে দরিদ্র এবং কৃষি-নির্ভর অর্থনীতির জন্য পরিচিত। এই অঞ্চলে প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন তুলো চাষি রয়েছে, যাদের ৯৫% ঋণের বোঝায় জর্জরিত। বিদর্ভে কৃষক আত্মহত্যার প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
- ঋণের বোঝা: বিদর্ভের কৃষকরা প্রায়শই ব্যাংক এবং স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ফসলের ব্যর্থতা এবং বাজার মূল্যের অস্থিরতার কারণে এই ঋণ পরিশোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০২৩ সালে মারাঠওয়াড়া অঞ্চলে ১,০৮৮ এবং বিদর্ভে ১,৪৩৯ কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, যার প্রধান কারণ ছিল ঋণ।
- অপর্যাপ্ত সেচ সুবিধা: বিদর্ভে মাত্র ৩৩,৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সেচ ব্যবস্থা রয়েছে। বেশিরভাগ কৃষক বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল, এবং অপ্রত্যাশিত মৌসুমি বৃষ্টি ফসলের ক্ষতির কারণ হয়।
- উচ্চ উৎপাদন খরচ: তুলো চাষে বীজ, কীটনাশক, এবং সারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু তুলোর বাজার মূল্য কমে গেছে। এটি কৃষকদের লাভের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
- সামাজিক অবকাঠামোর অভাব: বিদর্ভের গ্রামগুলিতে সারা বছরের রাস্তা, বিদ্যুৎ, পানীয় জল, এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অভাব রয়েছে, যা কৃষকদের জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তোলে।
মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে, বিদর্ভে কৃষকদের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, এবং বিষণ্ণতা ব্যাপক। ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মারাঠওয়াড়ায় প্রায় এক লক্ষ কৃষক আত্মহত্যার কথা ভাবছেন, যা ঋণ এবং ফসলের ক্ষতির চাপের ফলাফল।
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি সংকট
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি সংকট বিদর্ভের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। এখানে ধান, পাট, এবং সবজি চাষ প্রধান। তবে, কৃষক আত্মহত্যার হার বিদর্ভের তুলনায় কম হলেও, এই অঞ্চলেও কিছু গুরুতর সমস্যা রয়েছে:
- ফসলের ন্যায্য মূল্যের অভাব: পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা প্রায়শই ফসলের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP) থেকে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এটি তাদের আয়কে কমিয়ে দেয়।
- কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার: ১৯৭৯ সালে নন্দী এবং অন্যান্য গবেষকরা পশ্চিমবঙ্গে কৃষি কীটনাশকের সহজলভ্যতাকে আত্মহত্যার একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এই কীটনাশকগুলি সহজেই পাওয়া যায়, যা আত্মহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়।
- অর্থনৈতিক চাপ: পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ফসলের ব্যর্থতা এবং বাজার মূল্যের অস্থিরতা তাদের ঋণ পরিশোধে অক্ষম করে তোলে।
- জলবায়ু পরিবর্তন: অত্যধিক বৃষ্টি এবং বন্যার কারণে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা প্রায়ই ফসলের ক্ষতির সম্মুখীন হন। ২০২৩ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন কৃষকদের মানসিক চাপ বাড়িয়ে তুলছে।
পশ্চিমবঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বিদর্ভের তুলনায় কম আলোচিত হলেও, ২০০৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকায় ঘরোয়া সহিংসতা এবং আত্মহত্যার প্রবণতা মানসিক চাপের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বিদর্ভ বনাম বাংলা: তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বিদর্ভ এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষক আত্মহত্যার কারণগুলির মধ্যে কিছু মিল এবং পার্থক্য রয়েছে:
মিল:
- ঋণের বোঝা: উভয় অঞ্চলেই কৃষকরা মহাজন এবং ব্যাংকের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ফসলের ব্যর্থতা এবং কম মূল্য ঋণ পরিশোধকে অসম্ভব করে তোলে।
- জলবায়ু পরিবর্তন: অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি, খরা, এবং বন্যা উভয় অঞ্চলেই ফসলের ক্ষতির কারণ।
- মানসিক চাপ: ঋণ, ফসলের ক্ষতি, এবং সামাজিক চাপ কৃষকদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে।
পার্থক্য: - ফসলের ধরন: বিদর্ভে তুলো চাষ প্রধান, যা বাজারের অস্থিরতার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গে ধান এবং সবজি চাষ প্রধান, যা তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ।
- সেচ ব্যবস্থা: বিদর্ভে সেচের অভাব একটি বড় সমস্যা, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে বন্যা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টি বড় সমস্যা।
- মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা: বিদর্ভে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা এবং আলোচনা বেশি হয়েছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে এই বিষয়টি তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত।
সমাধানের পথ
কৃষক আত্মহত্যা রোধে উভয় অঞ্চলেই বেশ কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন:
- অর্থনৈতিক সহায়তা: ঋণ মুক্তি, ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নিশ্চিতকরণ, এবং ফসল বীমা স্কিম কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা দিতে পারে।
- সেচ ও কৃষি বিনিয়োগ: বিদর্ভে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি এবং পশ্চিমবঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
- মানসিক স্বাস্থ্য সেবা: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মসূচিকে গ্রামীণ এলাকায় শক্তিশালী করা এবং কৃষকদের জন্য কাউন্সেলিং সেবা চালু করা জরুরি।
- টেকসই কৃষি: জলবায়ু-সহনশীল ফসল এবং জৈব চাষের প্রচলন কৃষকদের ঝুঁকি কমাতে পারে।
বিদর্ভ এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষক আত্মহত্যার পেছনে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক কারণগুলির জটিল সমন্বয় রয়েছে। যদিও বিদর্ভে ঋণ এবং সেচের অভাব প্রধান সমস্যা, পশ্চিমবঙ্গে ফসলের ন্যায্য মূল্য এবং বন্যার সমস্যা বেশি। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলি উভয় অঞ্চলেই গুরুত্বপূর্ণ, তবে বিদর্ভে এটি বেশি আলোচিত। সরকারি নীতি, কৃষি বিনিয়োগ, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবার সমন্বিত প্রচেষ্টা এই সংকট মোকাবেলায় অত্যন্ত জরুরি।