অশ্বগন্ধা, যা ‘ভারতীয় জিনসেং’ বা ‘আয়ুর্বেদের রাজা’ নামেও পরিচিত, একটি প্রাচীন ঔষধি উদ্ভিদ যা আয়ুর্বেদ এবং ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর চাহিদা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগত বাড়ছে, বিশেষ করে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শারীরিক সক্ষমতা উন্নত করার জন্য। ভারতের কৃষকদের জন্য অশ্বগন্ধা চাষ (Ashwagandha Cultivation) একটি লাভজনক ব্যবসার সুযোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা অশ্বগন্ধা চাষের প্রক্রিয়া, ফলন, লাভের সম্ভাবনা এবং ভারতে ক্রেতা খোঁজার উপায় নিয়ে আলোচনা করব।
অশ্বগন্ধা চাষের প্রাথমিক ধারণা
অশ্বগন্ধা (বৈজ্ঞানিক নাম: Withania somnifera) একটি শক্তিশালী এবং খরা-সহনশীল উদ্ভিদ, যা শুষ্ক এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। এটি প্রধানত ভারতের মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশে চাষ করা হয়। মধ্যপ্রদেশের নিমুচ এবং মান্দসৌর বাজার অশ্বগন্ধার জন্য বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত। এই উদ্ভিদের শিকড়, বীজ এবং পাতা ঔষধি গুণসম্পন্ন, যা আয়ুর্বেদিক ওষুধ, ফার্মাসিউটিক্যাল, এবং কসমেটিক শিল্পে ব্যবহৃত হয়। অশ্বগন্ধা স্ট্রেস হ্রাস, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, হৃদরোগ প্রতিরোধ, এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
চাষের প্রক্রিয়া
অশ্বগন্ধা চাষের জন্য উপযুক্ত জলবায়ু এবং মাটির প্রয়োজন। এটি ৫০০-৮০০ মিমি বৃষ্টিপাত এবং ২০-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভালো জন্মে। বেলে দোআঁশ বা হালকা লাল মাটি, যার pH ৭.৫-৮.০, এবং ভালো নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকা আদর্শ। চাষের আগে জমি তৈরির জন্য ২-৩ বার চাষ এবং হালকা হ্যারো করা উচিত। জৈব সার, যেমন গোবর সার (৪-৮ টন প্রতি একর), ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিক সারের প্রয়োজন কম, তবে নিম্ন উর্বর মাটিতে প্রতি হেক্টরে ১৫ কেজি নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বীজ বপন দুইভাবে করা যায়: সরাসরি ছিটিয়ে বা নার্সারিতে চারা তৈরি করে রোপণ। খরিফ মৌসুমে (জুন-জুলাই) বা রবি মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) বীজ বপন করা যায়। প্রতি হেক্টরে ১০-১২ কেজি বীজ সরাসরি বপনের জন্য এবং ৫০০-৭৫০ গ্রাম বীজ নার্সারির জন্য যথেষ্ট। বীজ বপনের আগে থিরাম বা ডিথেন এম-৪৫ দিয়ে (৩ গ্রাম/কেজি) প্রক্রিয়াকরণ করা উচিত। ফসলের ফলন বাড়াতে ৬০ সেমি x ৩০ সেমি বা ৬০ সেমি x ৬০ সেমি দূরত্বে রোপণ করা হয়।
ফলন এবং ফসল সংগ্রহ
অশ্বগন্ধা ফসল ১৫০-১৮০ দিনের মধ্যে পরিপক্ক হয়, যখন পাতা শুকিয়ে যায় এবং ফল হলুদ-লাল হয়। শিকড় সংগ্রহের জন্য জমিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকা উচিত। পাওয়ার টিলার বা দেশি লাঙ্গল ব্যবহার করে শিকড় সাবধানে তুলতে হয়, যাতে ছোট পার্শ্বীয় শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রতি হেক্টরে গড়ে ৩০০-৫০০ কেজি শুকনো শিকড় এবং ৫০-৭৫ কেজি বীজ পাওয়া যায়। উন্নত জাত, যেমন জওয়াহর আসগন্ড-২০, জওয়াহর আসগন্ড-১৩৪, রক্ষিতা, বা পোষিতা, ব্যবহার করলে ফলন ৬৫০-১০০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।

লাভের সম্ভাবনা
অশ্বগন্ধা চাষে খরচ তুলনামূলক কম। প্রতি হেক্টরে চাষের খরচ প্রায় ১০,০০০-১৪,০০০ টাকা, যদি জমি নিজস্ব হয়। শুকনো শিকড়ের বিক্রয় মূল্য প্রতি কেজি ৯০-৬০০ টাকা এবং বীজের মূল্য ৭৫-১৫০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। গড়ে প্রতি হেক্টর থেকে ৩০,০০০ থেকে ১,২২,৫০০ টাকা পর্যন্ত লাভ সম্ভব। মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলার কৃষক প্রশান্ত প্যাটেল সাত ডিসমিল জমিতে অশ্বগন্ধা চাষ করে ৯৬,০০০ টাকার ফসল বিক্রি করেছেন এবং পরবর্তীতে চার একরে চাষ সম্প্রসারণ করেছেন। উন্নত জাত এবং ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লাভ ৬-৭ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।
ক্রেতা এবং বাজার
ভারতে অশ্বগন্ধার চাহিদা বছরে প্রায় ৭,০০০ টন, যেখানে উৎপাদন মাত্র ১,৫০০ টন। এই ঘাটতি কৃষকদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করেছে। নিমুচ এবং মান্দসৌর মান্ডি অশ্বগন্ধার প্রধান বাজার। হিমালয়া ওয়েলনেস, ডাবর, পতঞ্জলি, অর্গানিক ইন্ডিয়া, এবং ন্যাচারাল রেমেডিজের মতো কোম্পানি অশ্বগন্ধার বড় ক্রেতা। এছাড়া, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে এই কোম্পানিগুলো বীজ থেকে শুরু করে প্যাকেজিং পর্যন্ত সুবিধা প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, অর্গানিক ইন্ডিয়ার সাথে কাজ করা নিমুচের কৃষকরা ফেয়ারট্রেড সার্টিফিকেশন পেয়েছেন, যা তাদের ফসলের দাম বাড়িয়েছে এবং ১৫% ফেয়ারট্রেড প্রিমিয়াম প্রদান করেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে, অশ্বগন্ধার রপ্তানি চেক রিপাবলিক, কানাডা, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হয়। ২০২৩ সালে অশ্বগন্ধা বাজারের মূল্য ছিল ৬৯২.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০৩৪ সালের মধ্যে ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। কৃষকরা স্থানীয় মান্ডি, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, বা কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে ক্রেতাদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
অশ্বগন্ধা চাষে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন বাজারের অস্থিরতা, জলবায়ু পরিবর্তন, এবং রোগ-পোকামাকড়। ২০২৩ সালে, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফলন ২০% কমেছিল। নিমাটোড রোগ এবং পাতার দাগ থেকে রক্ষার জন্য বীজ প্রক্রিয়াকরণ এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা উচিত। কৃষকদের কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র বা বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
অশ্বগন্ধা চাষ ভারতের কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক এবং টেকসই ব্যবসার সুযোগ। কম বিনিয়োগ, উচ্চ চাহিদা, এবং সহজ চাষ পদ্ধতির কারণে এটি ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য আদর্শ। সঠিক পরিকল্পনা, উন্নত জাত, এবং বাজার সংযোগের মাধ্যমে কৃষকরা উল্লেখযোগ্য আয় করতে পারেন। সরকারের আয়ুষ মন্ত্রণালয় এবং ফেয়ারট্রেড উদ্যোগ এই চাষকে আরও সমৃদ্ধ করছে। অশ্বগন্ধা চাষ শুধু আর্থিক লাভই নয়, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্যও অবদান রাখছে।