ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে এগ্রোফরেস্ট্রির মাধ্যমে ৯Agroforestry Model India), যেখানে কৃষকরা গাছ ও ফসলের সমন্বয়ে তাদের আয় দ্বিগুণ করছেন। এই টেকসই কৃষি পদ্ধতি শুধুমাত্র লাভজনকই নয়, পরিবেশের জন্যও উপকারী। এগ্রোফরেস্ট্রি, যাকে কখনও কখনও এগ্রো-সিলভিকালচার বা বন কৃষি বলা হয়, একটি এমন পদ্ধতি যেখানে গাছ, ঝোপঝাড়, এবং ফসল বা গবাদি পশু একই জমিতে একত্রে চাষ করা হয়। এই পদ্ধতি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে, বিশেষ করে হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা এবং রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলিতে। এই প্রতিবেদনে আমরা জানব কীভাবে এগ্রোফরেস্ট্রি ভারতীয় কৃষকদের জন্য একটি টেকসই আয়ের উৎস হয়ে উঠছে এবং এর পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলি কী কী।
এগ্রোফরেস্ট্রি কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে?
এগ্রোফরেস্ট্রি হল এমন একটি ভূমি ব্যবহার পদ্ধতি যেখানে গাছ এবং ফসল বা গবাদি পশু একই জমিতে সমন্বিতভাবে চাষ করা হয়। এটি কৃষি ও বনায়নের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করে, যা কৃষকদের জন্য উৎপাদনশীলতা, লাভজনকতা, এবং পরিবেশগত টেকসইতা বৃদ্ধি করে। ভারতে এগ্রোফরেস্ট্রি ঐতিহ্যগতভাবে চর্চিত হয়ে আসছে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে কৃষকরা জ্বালানি কাঠ, ফল, এবং ঔষধি গাছের জন্য গাছ লাগিয়ে আসছেন। ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের (ICAR) সেন্ট্রাল এগ্রোফরেস্ট্রি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১৫টি কৃষি-জলবায়ু অঞ্চলে প্রায় ২৫ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে এগ্রোফরেস্ট্রি চর্চা হচ্ছে।
Also Read | কলকাতার বাজারে ব্যাপক চাহিদার ৫ সবজি, কৃষকদের জন্য বড় লাভের সুযোগ
এই পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মডেল, যেমন অ্যাগ্রিসিলভিকালচার (গাছ ও ফসলের সমন্বয়), সিলভোপ্যাস্টোরাল (গাছ ও গবাদি পশু), এবং অ্যাগ্রি-হর্টি-সিলভিকালচার (গাছ, ফসল, এবং ফলমূলের সমন্বয়)। হরিয়ানায় পপলার গাছের সঙ্গে গম এবং আখের চাষ, ওড়িশায় উপজাতি সম্প্রদায়ের আম, কাঁঠাল, এবং মহুয়া গাছের সমন্বয় এগ্রোফরেস্ট্রির সফল উদাহরণ। এই মডেলগুলি কৃষকদের জন্য একাধিক আয়ের উৎস তৈরি করে, যেমন কাঠ, ফল, গো-খাদ্য, এবং ঔষধি পণ্য।
অর্থনৈতিক সুবিধা: দ্বিগুণ লাভের পথ
এগ্রোফরেস্ট্রি কৃষকদের জন্য একাধিক আয়ের উৎস তৈরি করে, যা তাদের ঝুঁকি কমায় এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আসে। উদাহরণস্বরূপ, হরিয়ানায় পপলার গাছের সঙ্গে গম এবং আখ চাষ করে কৃষকরা বছরে লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। পপলার গাছ ৫-৭ বছরে কাটার উপযোগী হয়, যা প্লাইউড শিল্পের জন্য উচ্চমূল্যের কাঠ সরবরাহ করে। এই সময়ের মধ্যে কৃষকরা তাদের জমিতে ফসল চাষ করে অতিরিক্ত আয় করেন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পপলার-ভিত্তিক এগ্রোফরেস্ট্রি থেকে প্রতি হেক্টরে বার্ষিক নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু (NPV) এবং বেনিফিট-কস্ট রেশিও (B/C) ১২ শতাংশ ডিসকাউন্ট রেটে সর্বোচ্চ হয়।
এক্স-এ পোস্ট করা তথ্য অনুযায়ী, তামিলনাড়ুর সদায়ামপট্টুর শঙ্কর নামে একজন কৃষক পেঁপে এবং টেক গাছ চাষ করে বছরে ৫ লক্ষ টাকার বেশি আয় করছেন। আরেকজন কৃষক শুধুমাত্র ওয়াটার স্পিনাচ (অ্যাগ্রেটি) থেকে বছরে ৭৫,০০০ টাকা আয় করছেন। এই ধরনের উদাহরণ প্রমাণ করে যে এগ্রোফরেস্ট্রি কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করে এবং ফসলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে।
Also Read | ফেলে দেওয়া বর্জ্য থেকেই গড়ে তুলুন আয়
মধ্য ভারতের শুষ্ক অঞ্চলে বুটিয়া মনোস্পার্মা গাছের সঙ্গে লাক চাষ একটি জনপ্রিয় এগ্রোফরেস্ট্রি মডেল। এই গাছ থেকে প্রতি বছর ১.৫-২.৫ কেজি লাক উৎপাদন হয়, যা কৃষকদের ৭০০-৮০০ টাকা আয় করে দেয়। এছাড়াও, মৌমাছি পালন-ভিত্তিক এগ্রোফরেস্ট্রি কৃষকদের জন্য মধু উৎপাদনের মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ তৈরি করে এবং পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বাড়ায়।
পরিবেশগত সুবিধা: টেকসই কৃষির ভিত্তি
এগ্রোফরেস্ট্রি শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, এটি পরিবেশের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। গাছের শিকড় মাটির ক্ষয় রোধ করে, জল ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায় এবং মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে। নাইট্রোজেন-ফিক্সিং গাছ, যেমন অ্যাকাসিয়া এবং লিউকেনা, মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এগ্রোফরেস্ট্রি সিস্টেম প্রতি হেক্টরে ২৫-৫০ টন কার্বন সিকোয়েস্টার করতে পারে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে সহায়ক।
ভারতের শুষ্ক ও আধা-শুষ্ক অঞ্চলে, যেমন রাজস্থানে, প্রোসোপিস সিনেরারিয়া-ভিত্তিক এগ্রোফরেস্ট্রি ফসলের উৎপাদন বাড়ায় এবং খরার বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করে। গাছের ছায়া মাইক্রোক্লাইমেট উন্নত করে, যা ফসলকে তীব্র তাপ এবং খরা থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও, এগ্রোফরেস্ট্রি জৈব বৈচিত্র্য বাড়ায়, পাখি, পরাগরেণু বাহক পোকামাকড় এবং অন্যান্য প্রজাতির জন্য আবাসস্থল তৈরি করে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
যদিও এগ্রোফরেস্ট্রির সম্ভাবনা অপার, তবুও এর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার পথে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ এবং জমির সীমাবদ্ধতা একটি বড় বাধা। বড় কৃষকরা, যাদের জমির পরিমাণ বেশি, তারা এই পদ্ধতি সহজে গ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু ছোট কৃষকদের জন্য এটি চ্যালেঞ্জিং। এছাড়াও, এগ্রোফরেস্ট্রি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতাও একটি সমস্যা।
Also Read | পশ্চিমবঙ্গে কোল্ড স্টোরেজের ঘাটতি! পেঁয়াজ চাষিদের কীভাবে ধ্বংস করছে
ভারত সরকার ২০১৪ সালে জাতীয় এগ্রোফরেস্ট্রি নীতি প্রণয়ন করেছে, যা এই পদ্ধতির প্রসারে সহায়ক। এই নীতি কৃষকদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা, সহজ ঋণ, এবং বাজারের সুযোগ তৈরির উপর জোর দেয়। এছাড়াও, গ্রো বিলিয়ন ট্রিসের মতো সংস্থা কৃষকদের স্যাপলিং, প্রশিক্ষণ, এবং বাজার সংযোগ প্রদান করে এগ্রোফরেস্ট্রি প্রচার করছে। এআই এবং জিআইএস প্রযুক্তির ব্যবহার এই পদ্ধতির সম্ভাব্য অঞ্চল চিহ্নিত করতে এবং অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে সহায়ক।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
এগ্রোফরেস্ট্রি ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে একটি গেম-চেঞ্জার হতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই পদ্ধতি ভারতের কৃষি খাতের কার্বন পদচিহ্নের ৩০ শতাংশ কমাতে পারে এবং কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করতে পারে। সরকারি সহায়তা, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ, এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এগ্রোফরেস্ট্রি ভারতের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত, এগ্রোফরেস্ট্রি কৃষকদের জন্য শুধু একটি কৃষি পদ্ধতি নয়, এটি একটি জীবনধারা যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, পরিবেশগত ভারসাম্য, এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সমন্বয় ঘটায়। কল্যাণীর মতো ছোট শহর থেকে হরিয়ানার বিস্তীর্ণ কৃষি ক্ষেত্র পর্যন্ত, এই পদ্ধতি ভারতীয় কৃষকদের জন্য একটি নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে।