ক্রমবর্ধমান সারের দাম: ভারতের কৃষকরা কি এই সংকটে টিকে থাকতে পারবেন?

ভারতের কৃষি খাত, যা দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার মেরুদণ্ড, বর্তমানে একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি (Agricultural crisis)। সারের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকদের উপর আর্থিক…

Rising Fertilizer Prices Threaten Indian Farmers’ Survival in 2025 Crisis

ভারতের কৃষি খাত, যা দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার মেরুদণ্ড, বর্তমানে একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি (Agricultural crisis)। সারের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকদের উপর আর্থিক চাপ বাড়ছে, যা তাঁদের জীবিকা এবং ফসল উৎপাদনের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। ২০২২ সাল থেকে বিশ্ববাজারে সারের দাম ৩০% থেকে ৮০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং ২০২৫ সালেও এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। ভারত, যিনি সার আমদানির জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভরশীল, এই দাম বৃদ্ধির কারণে কৃষকদের জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সম্মুখীন। সরকারি ভর্তুকি থাকা সত্ত্বেও, কৃষকরা ক্রমবর্ধমান খরচের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এই সংকট কি ভারতের কৃষকদের টিকিয়ে রাখতে দেবে, নাকি তাঁরা এর কাছে পরাজিত হবেন?

সারের দাম বৃদ্ধির কারণ
বিশ্ববাজারে সারের দাম বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, যা ২০২২ সালে শুরু হয়েছিল, সার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস, ফসফেট এবং পটাশের সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। রাশিয়া এবং বেলারুশ, যারা বিশ্বের সার রপ্তানির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা সরবরাহ শৃঙ্খলাকে আরও জটিল করেছে। ফলস্বরূপ, ডি-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (DAP) এর দাম ২০২৩ সালে প্রতি টন ৪৪০ ডলার থেকে ৫৯৫ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ইউরিয়ার দামও ২০২২ সালের মে মাসে প্রতি টন ৭২২ ডলার থেকে ২০২৩ সালে ৩৩২ ডলারে নেমে এলেও, এটি এখনও প্রাক-মহামারী স্তরের তুলনায় ২০% বেশি। এছাড়া, চীনের সার রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা ভারতের মতো আমদানি-নির্ভর দেশগুলোর জন্য সমস্যা বাড়িয়েছে। ভারত বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন টন ইউরিয়া এবং ৫ মিলিয়ন টন DAP আমদানি করে, যা মোট চাহিদার প্রায় ৩০%।

   

কৃষকদের উপর প্রভাব
ভারতের কৃষকরা, বিশেষ করে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকরা, যারা দেশের কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫% গঠন করে, এই দাম বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সার কৃষি উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা ফসলের ফলন বাড়াতে এবং মাটির উর্বরতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। কিন্তু ইউরিয়া, DAP এবং মিউরেট অফ পটাশ (MOP) এর মতো সারের দাম বৃদ্ধি কৃষির ইনপুট খরচকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের কৃষক অমিত মণ্ডল জানান, “এক বস্তা DAP-এর দাম গত বছর ১২০০ টাকা ছিল, এখন তা ১৮০০ টাকা। আমার মতো ছোট কৃষকদের জন্য এই খরচ বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।” সারের দাম বৃদ্ধির ফলে অনেক কৃষক সারের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছেন, যা ফসলের ফলন এবং মাটির উর্বরতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলস্বরূপ, কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

সরকারি ভর্তুকি এবং এর সীমাবদ্ধতা
ভারত সরকার সারের উপর ভর্তুকি প্রদান করে কৃষকদের সহায়তা করার চেষ্টা করছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সার ভর্তুকির জন্য ১.৬৪ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ইউরিয়ার দাম নিয়ন্ত্রিত হলেও, DAP এবং অন্যান্য ফসফেটিক সারের দাম বাজার নির্ভর। এই ভর্তুকি কৃষকদের জন্য কিছুটা স্বস্তি দিলেও, সরবরাহ ঘাটতি এবং কালোবাজারি এই সুবিধাকে বাধাগ্রস্ত করছে। উত্তরপ্রদেশের একজন কৃষক, রামেশ্বর সিং, বলেন, “ভর্তুকি থাকলেও সার পাওয়া যায় না। দোকানে গেলে বলে স্টক নেই, আর কালোবাজারে দ্বিগুণ দামে কিনতে হয়।” এছাড়া, ভর্তুকির টাকা সঠিক সময়ে কৃষকদের হাতে পৌঁছায় না, যা তাঁদের আর্থিক সংকটে ফেলছে।

Advertisements

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
সারের দাম বৃদ্ধি শুধু কৃষকদের উপরই প্রভাব ফেলছে না, এটি সমগ্র অর্থনীতির উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কৃষি উৎপাদন কমে গেলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে, যা মুদ্রাস্ফীতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৫ সালে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ৬-৮% পর্যন্ত বাড়তে পারে। এছাড়া, কৃষকদের আর্থিক সংকট তাঁদের ঋণের বোঝা বাড়াচ্ছে। অনেক কৃষক স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছেন, যা তাঁদের আরও ঋণের জালে জড়াচ্ছে। সামাজিকভাবে, এই সংকট কৃষকদের মানসিক চাপ বাড়াচ্ছে, এবং কিছু ক্ষেত্রে চরম পদক্ষেপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

সমাধানের পথ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারের দাম নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষকদের সহায়তার জন্য দীর্ঘমেয়াদী সমাধান প্রয়োজন। প্রথমত, ভারতকে সার আমদানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। এর জন্য সার উৎপাদন কারখানায় বিনিয়োগ এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, জৈব সার এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচার করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে কিছু কৃষক জৈব সার ব্যবহার শুরু করেছেন, যা খরচ কমাতে সাহায্য করছে। তৃতীয়ত, সরকারকে ভর্তুকি বিতরণে স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং কালোবাজারি রোধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া, কৃষকদের জন্য সরাসরি আর্থিক সহায়তা এবং ফসলের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP) নিশ্চিত করা যেতে পারে।

ক্রমবর্ধমান সারের দাম ভারতের কৃষকদের জন্য একটি গুরুতর সংকট সৃষ্টি করেছে। সরকারি ভর্তুকি এবং স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ কিছুটা স্বস্তি দিলেও, এই সমস্যার সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশল প্রয়োজন। দেশীয় সার উৎপাদন বাড়ানো, জৈব কৃষির প্রচার এবং কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা এই সংকট মোকাবিলার মূল চাবিকাঠি। যদি এই পদক্ষেপগুলো সঠিক সময়ে না নেওয়া হয়, তাহলে কৃষকদের জীবিকা এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। কৃষকদের এই সংকট থেকে উদ্ধার করতে সরকার, কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।