ভারতের কৃষি খাতে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা হয়েছে, যেখানে কৃষি-প্রযুক্তি (অ্যাগ্রি-টেক) স্টার্টআপগুলি (Agri-Tech Startups) কৃষকদের জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে, খরচ কমাচ্ছে এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতি প্রচার করছে। এই স্টার্টআপগুলি কৃষকদের ফসল পর্যবেক্ষণ, সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে, যা ফলন বৃদ্ধি এবং পরিবেশগত প্রভাব হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারত, যেখানে কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং প্রায় ৩৩% কৃষি উৎপাদন মোট মূল্য সংযোজনে অবদান রাখে, সেখানে এই প্রযুক্তিগুলি কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এমন কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অ্যাগ্রি-টেক স্টার্টআপ এবং তাদের এআই ও ড্রোন প্রযুক্তির প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করব।
ভারতীয় অ্যাগ্রি-টেক স্টার্টআপগুলির (Agri-Tech Startups) উত্থান
ভারতের কৃষি খাতে প্রযুক্তির প্রয়োগ দ্রুত বাড়ছে। ফিকি-ইওয়াই-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের ড্রোন শিল্প ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পরিণত হতে পারে। ২০২২ সালে কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রী ড্রোন ক্রয়ের জন্য কৃষকদের জন্য ৪০-৫০% ভর্তুকি ঘোষণা করেছেন, যা কৃষি কাজকে সহজ এবং উৎপাদনশীল করতে সহায়তা করছে। এই উদ্যোগের ফলে অ্যাগ্রি-টেক স্টার্টআপগুলি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এই স্টার্টআপগুলি কৃষকদের ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ, জল এবং সারের ব্যবহার অপ্টিমাইজ করা এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে।

উল্লেখযোগ্য অ্যাগ্রি-টেক স্টার্টআপ এবং তাদের প্রযুক্তি
১. ফসল: ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক এই স্টার্টআপটি এআই এবং ডেটা সায়েন্সের মাধ্যমে কৃষকদের জন্য রিয়েল-টাইম ভবিষ্যদ্বাণীমূলক পরামর্শ প্রদান করে। ফসলের আইওটি ডিভাইস মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। এই ডেটা বিশ্লেষণ করে এআই অ্যালগরিদম কৃষকদের সেচ, সার এবং কীটনাশকের সঠিক ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। ২০২৩ সালে ফসল ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের সাথে অংশীদারিত্ব করে কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে। এই প্রযুক্তি জল এবং সারের অপচয় কমিয়ে ফলন বাড়াতে সহায়তা করছে।
২. ক্রপিন: ২০১০ সালে কৃষ্ণ কুমার এবং কুনাল প্রসাদ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই বেঙ্গালুরু-ভিত্তিক স্টার্টআপটি কৃষকদের জন্য একটি ডিজিটাল ফার্ম ম্যানেজমেন্ট প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে। ক্রপিনের স্মার্টফার্ম প্লাস সলিউশন স্যাটেলাইট ডেটা, ড্রোন এবং আইওটি ডিভাইসের মাধ্যমে ফসলের স্বাস্থ্য, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেয়। এই প্ল্যাটফর্ম কৃষকদের ফসলের গুণমান উন্নত করতে এবং বাজারে সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। ক্রপিন ৫ মিলিয়নেরও বেশি কৃষককে সেবা দিয়েছে এবং গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশে কাজ করছে।
৩. ডিহাট: ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পাটনা-ভিত্তিক স্টার্টআপটি কৃষকদের জন্য এন্ড-টু-এন্ড কৃষি সেবা প্রদান করে। ডিহাটের প্ল্যাটফর্ম কৃষকদের উচ্চমানের কৃষি উপকরণ, এআই-ভিত্তিক ফসল পরামর্শ এবং বাজার সংযোগ প্রদান করে। এই স্টার্টআপটি ১১টি রাজ্যে ২ মিলিয়নেরও বেশি কৃষকের সাথে কাজ করে এবং ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে ফসল পর্যবেক্ষণ এবং স্প্রে সেবা প্রদান করে। ডিহাট ২০২৪ সালে ড্রোন ডেস্টিনেশনের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।
৪. থানোস টেকনোলজিস: ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্টার্টআপটি ভারতের অন্যতম প্রধান কৃষি ড্রোন প্রস্তুতকারক। থানোসের SYENA-H10i ড্রোন প্রতিদিন ৪০ একর জমিতে স্প্রে করতে পারে, যা জিপিএস এবং রাডার প্রযুক্তির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট স্প্রে সেবা প্রদান করে। এই ড্রোনগুলি কীটনাশক এবং সারের অপচয় কমায় এবং পরিবেশের উপর প্রভাব হ্রাস করে।
৫. লেহের: এই ভারতীয় স্টার্টআপটি কৃষকদের জন্য ড্রোন-অ্যাজ-এ-সার্ভিস (DaaS) মডেল প্রদান করে। কৃষকরা লেহেরের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ড্রোন বুক করতে পারেন, যা সেন্সর এবং জিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুনির্দিষ্টভাবে কীটনাশক এবং সার প্রয়োগ করে। এই সেবা জল, শ্রম এবং উপকরণের খরচ কমায়।
এআই এবং ড্রোন প্রযুক্তির সুবিধা
এআই এবং ড্রোন প্রযুক্তির একীকরণ কৃষকদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা নিয়ে এসেছে:
ফসল পর্যবেক্ষণ: মাল্টিস্পেকট্রাল এবং থার্মাল ক্যামেরা সহ ড্রোনগুলি ফসলের স্বাস্থ্য, পানির চাপ এবং কীটপতঙ্গের সমস্যা শনাক্ত করে। উদাহরণস্বরূপ, ব্লু রিভার টেকনোলজির স্মার্ট স্প্রেয়ার ৯০% পর্যন্ত হার্বিসাইড ব্যবহার কমিয়েছে।
- সুনির্দিষ্ট স্প্রে: এআই-চালিত ড্রোনগুলি নির্দিষ্ট এলাকায় কীটনাশক এবং সার প্রয়োগ করে, যা অপচয় এবং পরিবেশ দূষণ কমায়।
- ফলন ভবিষ্যদ্বাণী: এআই অ্যালগরিদম ফসলের বৃদ্ধির ধরণ এবং ঐতিহাসিক ডেটা বিশ্লেষণ করে ফলনের সঠিক পূর্বাভাস দেয়, যা কৃষকদের পরিকল্পনা করতে সহায়তা করে।
- শ্রম ঘাটতি সমাধান: স্বায়ত্তশাসিত ড্রোন এবং রোবট শ্রমের ঘাটতি পূরণ করে এবং কায়িক শ্রমের উপর নির্ভরতা কমায়।
ভারতে অ্যাগ্রি-টেক প্রচারে চ্যালেঞ্জ
যদিও এআই এবং ড্রোন প্রযুক্তি কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটাচ্ছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রিন্টের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ, বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব এবং স্মার্টফোনের সীমিত প্রবেশাধিকার গ্রামীণ কৃষকদের জন্য প্রযুক্তি গ্রহণে বাধা। উদাহরণস্বরূপ, কোডাগুর মৌমাছি পালক সীনা কাপ্পু বীপ্রিসাইসের সেন্সর কিনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতি মৌচাকের জন্য ৩,০০০-৭,৫০০ টাকার দাম তার বাজেটের বাইরে ছিল। এছাড়া, অনেক কৃষক ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির প্রতি আস্থাশীল, যা নতুন প্রযুক্তির গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়।
তবে, সরকার এবং বেসরকারি খাত এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করছে। কর্ণাটক, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু এবং মধ্যপ্রদেশের রাজ্য সরকারগুলি ড্রোন নির্মাতা, কৃষক উৎপাদক সংগঠন এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সাথে সহযোগিতা করছে। এছাড়া, স্থানীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ড্রোন-অ্যাজ-এ-সার্ভিস মডেল কৃষকদের জন্য প্রযুক্তির প্রবেশাধিকার সহজ করছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অ্যাগ্রি-টেক স্টার্টআপগুলি ভারতের কৃষি খাতকে আরও টেকসই এবং লাভজনক করার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। নীতি আয়োগের মতে, ভারতের অ্যাগ্রি-টেক বাজার ২৪ বিলিয়ন ডলারের মূল্যে পৌঁছতে পারে। এআই এবং ড্রোন প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে, কৃষকরা আরও সুনির্দিষ্ট এবং তথ্য-চালিত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। ভবিষ্যতে, লিডার প্রযুক্তি এবং উন্নত মেশিন লার্নিং মডেলের মাধ্যমে ড্রোনগুলি আরও স্বায়ত্তশাসিত হবে এবং জটিল বিশ্লেষণ প্রদান করবে।
এআই এবং ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে অ্যাগ্রি-টেক স্টার্টআপগুলি ভারতীয় কৃষকদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। ফসল, ক্রপিন, ডিহাট, থানোস এবং লেহেরের মতো স্টার্টআপগুলি কৃষি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, সরকারি ভর্তুকি, স্থানীয় প্রশিক্ষণ এবং সহযোগিতার মাধ্যমে এই প্রযুক্তিগুলি আরও বেশি কৃষকের কাছে পৌঁছাচ্ছে। ভবিষ্যতে, এই প্রযুক্তিগুলি ভারতের কৃষি খাতকে আরও শক্তিশালী এবং টেকসই করে তুলবে, যা কৃষকদের জীবনমান উন্নত করবে এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।