চা নয়, এ বার কফির সুবাসে মাতছে পাহাড়ি শহর কালিম্পং। ইতিহাসের পাতায় নতুন এক অধ্যায় রচনা করছে উত্তরবঙ্গের এই এলাকা, যেখানে এত দিন ধরে চা-ই ছিল চাষের প্রধান অবলম্বন। তবে এখন সময় বদলেছে। দু’টো পাতা, একটা কুঁড়ির গল্পকে পাশ কাটিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে কফির সুবাস। আর এই কফিই বদলে দিচ্ছে বহু কৃষকের জীবন, বুনে দিচ্ছে নতুন স্বপ্ন।
কালিম্পংয়ের নাম নিলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজ পাহাড়, শান্ত প্রকৃতি আর ঠান্ডা হাওয়া। আর তার সঙ্গে যুক্ত ছিল চায়ের ঐতিহ্য। কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে শুরু হওয়া পরীক্ষামূলক কফি চাষ এখন রীতিমতো কৃষি-আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। প্রথম দিকে কফি চাষ শুরু হয়েছিল ছোট পরিসরে। তখন অনেকেই জানতেন না এই মাটিতে কফি গাছ এমন সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই চিত্রটা পাল্টে গিয়েছে।
বর্তমানে কালিম্পংয়ের প্রায় ৪০০ একর জমিতে ছড়িয়ে পড়েছে কফির চাষ। ভালুখোপ, আলগারাহ, গিম্বালিং ও লেলে গাঁওয়ের মতো জায়গায় তৈরি হয়েছে কফি চাষের ক্লাস্টার। গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (GTA) উদ্যোগে ও কৃষি দপ্তরের সহযোগিতায় এই উদ্যোগ শুরু হলেও এখন তা আত্মনির্ভর ও লাভজনক প্রকল্পে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে বছরে কালিম্পং থেকে ২৭ টনের বেশি কফি সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ১২ টন আসে সরকারি জমি থেকে এবং ১৫ টন বেসরকারি জমি থেকে। কফির মান এতটাই উন্নত যে তা শুধু ভারতের বাজারেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও সমাদৃত। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে রপ্তানি হচ্ছে কালিম্পংয়ের কফি। এমনকি নেপালের বাজারেও চাহিদা রয়েছে এই কফির।
এই বিপ্লবের পিছনে রয়েছেন কালিম্পংয়ের ১২০০-এর বেশি কৃষক। তাঁদের বহুজনই আগে আলু বা ভুট্টার চাষ করতেন। কিন্তু লাভের আশায় এখন তাঁরা ঝুঁকেছেন কফির দিকে। শুধু চাষ নয়, এখন কালিম্পংয়ে তৈরি হয়েছে নিজস্ব কফি ব্র্যান্ডও— ‘কালিম্পং কফি’ ও ‘কালিম্পং ফিল্টার কফি’। এই ব্র্যান্ডগুলি রাজ্য সরকারের বিশ্ব বাংলা স্টোরেও পাওয়া যাচ্ছে, যা ব্র্যান্ড পরিচিতিতে দারুণ সাহায্য করছে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—গুণমানের দিক থেকে এই কফি পিছিয়ে নেই বিশ্বের সেরা কফি উৎপাদনকারী দেশগুলির থেকে। কেনিয়া কিংবা কলম্বিয়ার কফির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো মানের বলে দাবি করছেন কৃষিবিদরা ও রপ্তানিকারকেরা।
সরকারি সহায়তায় যেমন কৃষকরা পেয়েছেন বীজ, প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ, তেমনই নতুন কৃষকদেরও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে এই প্রকল্পে যোগ দিতে। কফি প্রসেসিং ইউনিট, প্যাকেজিং, ব্র্যান্ডিং সব মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন এক আর্থিক পরিবেশ। এই কফি চাষ ঘিরে পর্যটনের নতুন দিকও খুলছে। কফি ট্যুরিজম, হোমস্টে সংস্কৃতি ও স্থানীয় বিপণনের সঙ্গে মিলিয়ে তা হয়ে উঠছে একটি পূর্ণাঙ্গ মডেল।
এই কফি বিপ্লব শুধু আর্থিক উন্নতির গল্প নয়, এটি পাহাড়ি জীবনযাত্রায় এক মৌলিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতও বটে। যে কালিম্পং এত দিনে চায়ের পাতায় সুগন্ধ ছড়াত, আজ সেখান থেকে ভেসে আসছে কফির ঘ্রাণ। আগামী দিনে এই কফি হতে পারে উত্তরবঙ্গের অন্যতম সেরা রপ্তানি পণ্য।