ভারতের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড হল খরিফ মরসুম (Kharif Season Crop), যা জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চলে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল। ২০২৫ সালের খরিফ মরসুমে ফসলের ধরণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এবং কৌশলগত পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে, যা কৃষকদের জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৫ সালের খরিফ মরসুমের প্রধান ফসল, তাদের চাষের ধরণ, মৌসুমি বৃষ্টির প্রভাব এবং কৃষকদের জন্য প্রস্তুতির কৌশল নিয়ে আলোচনা করব।
২০২৫ খরিফ মরসুমের ফসলের ধরণ
খরিফ মরসুমে ভারতে চাষ করা প্রধান ফসলগুলির মধ্যে রয়েছে ধান, ভুট্টা, তুলা, সয়াবিন, ডাল জাতীয় ফসল (যেমন তুর, উড়দ, মুগ), তৈলবীজ (যেমন সয়াবিন, চিনাবাদাম, তিল) এবং আখ। এই ফসলগুলি উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল, যা মৌসুমি বৃষ্টির সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। ২০২৫ সালে খরিফ মরসুমের ফসল বপনের অগ্রগতি সম্পর্কে সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে স্বাভাবিক বপন এলাকার প্রায় ৪০% বপন সম্পন্ন হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১১% বৃদ্ধি পেয়েছে। ধান, ডাল জাতীয় ফসল এবং তৈলবীজের বপন তুলনামূলকভাবে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। তবে, কিছু ফসল যেমন তুলা এবং জোয়ারের বপন গত বছরের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।
ধান: ধান ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খরিফ ফসল, যা পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং বিহারের মতো রাজ্যে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি এবং বিশ্বে চীনের পরে ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তম ধান উৎপাদনকারী দেশ। ধানের চাষের জন্য ১০০-১৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত এবং ১৬-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। ২০২৫ সালে ধান বপনের এলাকা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভালো মৌসুমি বৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়।
ডাল জাতীয় ফসল: তুর (আরহার), উড়দ এবং মুগ জাতীয় ডাল ফসল খরিফ মরসুমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ফসলগুলি মাটির উর্বরতা বাড়ায় কারণ এগুলি নাইট্রোজেন স্থিরকরণে সহায়তা করে। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, এবং রাজস্থানে এই ফসলগুলির চাষ বেশি হয়। ২০২৫ সালে ডাল ফসলের বপন বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তৈলবীজ: সয়াবিন, চিনাবাদাম এবং তিলের মতো তৈলবীজ ফসলগুলি খরিফ মরসুমে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটে এই ফসলগুলির চাষ উল্লেখযোগ্য। তবে, সয়াবিনের বপন এ বছর কিছুটা কম হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
তুলা এবং আখ: তুলা মহারাষ্ট্র, গুজরাট এবং অন্ধ্রপ্রদেশে একটি প্রধান নগদ ফসল। আখ উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটকে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। এই ফসলগুলি কৃষকদের আয় বাড়ায় এবং শিল্পের জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করে।
মৌসুমি বৃষ্টির প্রভাব
খরিফ ফসল মূলত বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল, তাই মৌসুমি বৃষ্টির সময় এবং পরিমাণ ফসলের উৎপাদনশীলতার উপর বড় প্রভাব ফেলে। ২০২৫ সালে ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (IMD) স্বাভাবিক বা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়েছে, যা ধান, ভুট্টা এবং তৈলবীজের মতো ফসলের জন্য ইতিবাচক। তবে, অতিরিক্ত বৃষ্টি বা বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের মতো রাজ্যে।
কৃষকদের জন্য ফসল বীমা যেমন প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা (PMFBY) এই মরসুমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জেলা প্রশাসনগুলি কৃষকদের এই বীমায় নথিভুক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করছে, যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষতি হলে তারা আর্থিক সুরক্ষা পায়।
কৃষকদের জন্য প্রস্তুতির কৌশল
২০২৫ সালের খরিফ মরসুমে সফলতা অর্জনের জন্য কৃষকদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
- মাটি পরীক্ষা: বপনের আগে মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত। এটি সঠিক সার এবং ফসল নির্বাচনে সহায়তা করবে।
- উন্নত বীজ নির্বাচন: উচ্চ ফলনশীল এবং জলবায়ু-সহনশীল বীজ ব্যবহার করা ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে।
- জল ব্যবস্থাপনা: অতিরিক্ত বৃষ্টি বা খরার জন্য সেচ ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা উচিত।
- ফসল বৈচিত্র্যকরণ: ধানের পাশাপাশি ডাল, তৈলবীজ এবং জোয়ারের মতো ফসল চাষ করলে ঝুঁকি কমবে এবং আয় বাড়বে।
সরকারি উদ্যোগ এবং ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP)
সরকার ২০২৫-২৬ খরিফ মরসুমের জন্য ১৪টি ফসলের জন্য ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP) ঘোষণা করেছে। নাইজার বীজের জন্য সর্বোচ্চ বৃদ্ধি (৮২০ টাকা/কুইন্টাল), এবং রাগি, তুলা, তিল, তুর এবং উড়দের জন্যও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘোষণা করা হয়েছে। এই পদক্ষেপ কৃষকদের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
খরিফ মরসুমে কৃষকদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হল জলবায়ু পরিবর্তন, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণ। এই সমস্যাগুলি মোকাবেলায় সরকার এবং কৃষি বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা, যেমন আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ, গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও, কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং ঋণ সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে, যাতে তারা আধুনিক কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে।
২০২৫ সালের খরিফ মরসুম ভারতের কৃষি অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। ধান, ডাল, তৈলবীজ এবং তুলার মতো ফসলগুলি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের জীবিকা নির্বাহে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মৌসুমি বৃষ্টির পূর্বাভাস এবং সরকারি উদ্যোগ এই মরসুমে কৃষকদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে, সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে কৃষকরা এই মরসুমকে সফল করতে পারে। ২০২৫ সালের খরিফ মরসুম কৃষকদের সমৃদ্ধি এবং দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।