দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিবছরই রাজ্য সরকার পুজো কমিটিগুলিকে আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। তবে সেই অনুদান কিভাবে খরচ হচ্ছে, সমস্ত ক্লাব কি সঠিকভাবে তার হিসেব দিচ্ছে—এ নিয়েই সম্প্রতি মামলা দায়ের হয় কলকাতা হাই কোর্টে (High Court) । সেই মামলার শুনানিতে হাই কোর্ট রাজ্য সরকারকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, গত বছর পর্যন্ত কোন কোন পুজো কমিটি খরচের পূর্ণাঙ্গ হিসেব জমা দিয়েছে এবং কোনগুলি দেয়নি, তার বিস্তারিত তথ্য-সহ হলফনামা জমা দিতে হবে আদালতে।
আদালতের নির্দেশ
কলকাতা হাই কোর্টের (High Court) বেঞ্চ জানিয়েছে, যেহেতু অনুদানের টাকা সরকারি তহবিল থেকে আসে, তাই এর খরচের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি। আদালতের বক্তব্য, “জনগণের করের টাকাই এই অনুদানের মূল উৎস। সেই টাকা খরচ হচ্ছে ঠিক কোথায়, কীভাবে—এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য আদালতের সামনে আসা উচিত।”
ফলে রাজ্যকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিস্তারিত হলফনামা পেশ করতে হবে।
অনুদান ও বিতর্ক
উল্লেখযোগ্য বিষয়, ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে দুর্গাপুজো কমিটিগুলিকে আর্থিক অনুদান দেওয়া শুরু হয়। প্রথমদিকে এই অনুদানের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার টাকা, যা ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে এখন কয়েক গুণ হয়েছে। শেষ কয়েক বছরে প্রতিটি অনুমোদিত পুজো কমিটি ৭০-৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অনুদান পেয়েছে।
তবে বিরোধীরা বারবার অভিযোগ তুলেছে, এই অনুদান মূলত ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির অংশ। তাদের দাবি, সরকারি তহবিলের টাকা পুজো কমিটিগুলিকে দিয়ে বাস্তবে কোনও সামাজিক উন্নয়ন ঘটছে না। বরং এই অনুদান নির্বাচনের আগে সংগঠনগুলিকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্বচ্ছতার প্রশ্নে আদালতের কড়া অবস্থান
আদালতের নির্দেশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত কোন কোন ক্লাব অনুদানের টাকা খরচের বিস্তারিত অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছে, আর কারা দেয়নি—এই তালিকা হলফনামার আকারে আদালতে জমা করতে হবে। সেই সঙ্গে অনুদান গ্রহণকারী প্রতিটি ক্লাবের নাম, প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ এবং হিসেব দেওয়ার সময়কালও স্পষ্টভাবে জানাতে হবে।
এর ফলে রাজ্যের প্রায় সব বড় পুজো কমিটিই এই নির্দেশের আওতায় আসবে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আদালতের এই নির্দেশ ভবিষ্যতে সরকারি অনুদান বণ্টনের ক্ষেত্রে নজির হয়ে দাঁড়াতে পারে।
রাজ্যের প্রতিক্রিয়া
রাজ্য সরকারের তরফে আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তারা আদালতের নির্দেশ মানতে প্রস্তুত। ইতিমধ্যেই অর্থ দফতর ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দপ্তরগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তথ্য সংগ্রহ শুরু করার জন্য। তবে সরকারি সূত্রের দাবি, অধিকাংশ বড় পুজো কমিটি অনুদানের খরচের হিসেব নিয়ম মেনেই জমা দেয়। কিছু ছোট কমিটি হয়তো দেরিতে করে বা সম্পূর্ণ তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেগুলিও এবার স্পষ্টভাবে আদালতের সামনে হাজির করা হবে।
বিরোধীদের বক্তব্য
অন্যদিকে বিরোধী দলগুলির দাবি, আদালতের এই পদক্ষেপে রাজ্যের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ্যে আসবে। এক বিরোধী নেতা বলেন, “আমরা বারবার বলেছি, সরকারি টাকা কিভাবে খরচ হচ্ছে তার স্বচ্ছতা নেই। এবার আদালতের হস্তক্ষেপে সব বেরিয়ে আসবে।”
তৃণমূল অবশ্য পাল্টা যুক্তি দিয়েছে, অনুদান দেওয়া হয় পুজো কমিটিগুলিকে সামাজিক কাজের জন্য—যেমন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সিসিটিভি বসানো, পরিচ্ছন্নতা বা সামাজিক উদ্যোগ। ফলে এর সঠিক হিসেব রাখা হয় এবং আদালতে তা জমা দেওয়া হবে।