বাংলার ছোট আইটি স্টার্টআপগুলির মুখোমুখি জিএসটি ও কর সমস্যা

ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে পশ্চিমবঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে কলকাতা এবং শিলিগুড়ির মতো শহরগুলি ছোট আইটি স্টার্টআপগুলির (IT Startups) জন্য একটি সমৃদ্ধ…

GST and Tax Challenges for Small IT Startups in Bengal

ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে পশ্চিমবঙ্গ একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে কলকাতা এবং শিলিগুড়ির মতো শহরগুলি ছোট আইটি স্টার্টআপগুলির (IT Startups) জন্য একটি সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেম তৈরি করছে। তবে, এই স্টার্টআপগুলি তাদের প্রাথমিক পর্যায়ে জিএসটি (গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স) এবং অন্যান্য কর সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এই প্রতিবেদনে আমরা বাংলার ছোট আইটি স্টার্টআপগুলির মুখোমুখি জিএসটি ও কর সমস্যাগুলি এবং তাদের সমাধানের উপায় নিয়ে আলোচনা করব।
জিএসটি ও কর সমস্যা

১. জটিল জিএসটি সম্মতি প্রক্রিয়া
জিএসটি, যা ২০১৭ সালে চালু হয়েছিল, ভারতের পরোক্ষ কর ব্যবস্থাকে সরল করার লক্ষ্যে প্রবর্তিত হয়েছিল। তবে, ছোট আইটি স্টার্টআপগুলির জন্য জিএসটি সম্মতি একটি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। মাসিক বা ত্রৈমাসিক রিটার্ন ফাইল করা, ই-ইনভয়েসিং, এবং ইনপুট ট্যাক্স ক্রেডিট (আইটিসি) দাবি করার জন্য সঠিক ডকুমেন্টেশন প্রয়োজন। অনেক স্টার্টআপ, যাদের সীমিত জনবল এবং সম্পদ রয়েছে, এই প্রক্রিয়াগুলি পরিচালনা করতে হিমশিম খায়। উদাহরণস্বরূপ, সঠিকভাবে ইনভয়েস তৈরি না করা বা সরবরাহকারীর জিএসটি সম্মতি না থাকলে আইটিসি দাবিতে বিলম্ব হতে পারে, যা নগদ প্রবাহে প্রভাব ফেলে।

   

২. উচ্চ কর হার এবং বিপরীত চার্জ প্রক্রিয়া
আইটি পরিষেবাগুলির উপর ১৮% জিএসটি আরোপ করা হয়, যা পূর্ববর্তী ১৫% সার্ভিস ট্যাক্সের তুলনায় বেশি। এছাড়া, বিদেশি ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করা স্টার্টআপগুলিকে বিপরীত চার্জ প্রক্রিয়ার (Reverse Charge Mechanism – RCM) অধীনে ১৮% জিএসটি দিতে হয়, যা তাদের নগদ প্রবাহের উপর চাপ সৃষ্টি করে। যেহেতু অনেক স্টার্টআপ লাভের পরিবর্তে ক্ষতির মধ্যে থাকে, তাই আইটিসি ক্রেডিট সেট-অফ করার জন্য পর্যাপ্ত আউটপুট ট্যাক্স না থাকায় তারা আর্থিক চাপের মুখে পড়ে।

৩. ঘন ঘন পরিবর্তনশীল কর নিয়ম
ভারতের কর নিয়ম ঘন ঘন পরিবর্তিত হয়, যা ছোট স্টার্টআপগুলির জন্য এই পরিবর্তনগুলির সাথে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালে জিএসটি রেজিস্ট্রেশনের জন্য নতুন নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে, যেমন বার্ষিক টার্নওভার ৫ কোটি টাকার বেশি হলে বাধ্যতামূলক ই-ইনভয়েসিং। এই নিয়মগুলি সম্পর্কে অজ্ঞতা বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে স্টার্টআপগুলি জরিমানার মুখোমুখি হতে পারে।

৪. নগদ প্রবাহ এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা
ছোট আইটি স্টার্টআপগুলির প্রায়ই সীমিত নগদ প্রবাহ থাকে। জিএসটি পেমেন্ট এবং অন্যান্য কর সম্মতির জন্য অগ্রিম অর্থ প্রদানের প্রয়োজন হয়, যা তাদের আর্থিক সংকট আরও বাড়িয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, দেরিতে রিটার্ন ফাইল করলে প্রতিদিন ৫০ টাকা জরিমানা এবং ১৮% সুদ ধার্য হয়। এই ধরনের জরিমানা ছোট স্টার্টআপগুলির জন্য বড় আর্থিক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

৫. ডকুমেন্টেশন এবং রেকর্ড-কিপিং
জিএসটি সম্মতির জন্য বিস্তারিত রেকর্ড-কিপিং প্রয়োজন, যেমন ইনভয়েস, পেমেন্ট রেকর্ড, এবং সরবরাহকারীর জিএসটি সম্মতি সংক্রান্ত তথ্য। অনেক স্টার্টআপ সঠিক ইনভয়েস তৈরি করতে ব্যর্থ হয় বা ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক খরচ মিশ্রিত করে, যা অডিটের সময় সমস্যা সৃষ্টি করে।

বাংলার আইটি স্টার্টআপগুলির জন্য নির্দিষ্ট চ্যালেঞ্জ
পশ্চিমবঙ্গের আইটি স্টার্টআপগুলি, বিশেষ করে কলকাতার সেক্টর V এবং নিউ টাউনের মতো এলাকায়, জিএসটি সম্মতির জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। স্থানীয় ব্যবসায়িক পরিবেশে সীমিত ট্যাক্স পেশাদারদের উপলব্ধতা এবং উচ্চ পরামর্শ ফি এই স্টার্টআপগুলির জন্য সমস্যা তৈরি করে। এছাড়া, অনেক স্টার্টআপ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিষেবা প্রদান করে, যেখানে জিএসটি রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক, এমনকি টার্নওভার থ্রেশহোল্ডের নিচে থাকলেও।

সমাধানের উপায়
জিএসটি এবং কর সমস্যাগুলি মোকাবিলা করার জন্য বাংলার ছোট আইটি স্টার্টআপগুলি নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে:

Advertisements

১. পেশাদার সহায়তা নেওয়া
স্টার্টআপগুলির উচিত একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা ট্যাক্স পেশাদারের সহায়তা নেওয়া, যিনি জিএসটি সম্মতি এবং রিটার্ন ফাইলিংয়ে সহায়তা করতে পারেন। এটি ভুল এবং জরিমানার ঝুঁকি কমাবে।

২. প্রযুক্তির ব্যবহার
জিএসটি সম্মতির জন্য ক্লিয়ার, ক্যাপ্টেনবিজ বা সুভিটের মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে, যা ইনভয়েসিং, রেকর্ড-কিপিং, এবং রিটার্ন ফাইলিংকে সহজ করে। এই সফটওয়্যারগুলি স্টার্টআপগুলির সময় এবং খরচ বাঁচায়।

৩. জিএসটি কম্পোজিশন স্কিম
১.৫ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভার সহ স্টার্টআপগুলি জিএসটি কম্পোজিশন স্কিমের জন্য আবেদন করতে পারে, যা কম হারে কর প্রদানের সুবিধা দেয়। তবে, এই স্কিমে আইটিসি দাবি করা যায় না, তাই স্টার্টআপগুলির উচিত তাদের ব্যবসায়িক মডেলের উপর ভিত্তি করে এটি বেছে নেওয়া।

৪. সরবরাহকারী যাচাই
আইটিসি দাবি করার জন্য স্টার্টআপগুলির উচিত তাদের সরবরাহকারীদের জিএসটি সম্মতি যাচাই করা। সরবরাহকারী যদি সময়মতো রিটার্ন ফাইল না করে, তবে আইটিসি দাবিতে সমস্যা হতে পারে।

৫. স্টার্টআপ ইন্ডিয়া সুবিধা
স্টার্টআপ ইন্ডিয়া উদ্যোগের অধীনে DPIIT-স্বীকৃত স্টার্টআপগুলি ৩ বছরের জন্য ১০০% ইনকাম ট্যাক্স ছাড় এবং ক্যাপিটাল গেইনস ট্যাক্স থেকে মুক্তি পেতে পারে। বাংলার স্টার্টআপগুলি এই সুবিধাগুলি গ্রহণের জন্য আবেদন করতে পারে।

সরকারি ও সামাজিক উদ্যোগ
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাংলার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যেমন ওয়েবেল (West Bengal Electronics Industry Development Corporation) এর মাধ্যমে ইনকিউবেটর এবং ফান্ডিং সুবিধা প্রদান। তবে, জিএসটি সম্মতি সহজ করার জন্য আরও স্থানীয় কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের প্রয়োজন।

বাংলার ছোট আইটি স্টার্টআপগুলি জিএসটি এবং কর সম্মতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেও, সঠিক পদক্ষেপ এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। প্রযুক্তির ব্যবহার, পেশাদার সহায়তা, এবং সরকারি সুবিধাগুলি ব্যবহার করে স্টার্টআপগুলি তাদের সম্মতি প্রক্রিয়াকে সহজ করতে পারে এবং বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করতে পারে। বাংলার আইটি স্টার্টআপগুলির সম্ভাবনা অপার, এবং কর সমস্যাগুলি সমাধানের মাধ্যমে তারা ভারতের প্রযুক্তি জগতে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে।