ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্র আর ঐতিহ্যবাহী ট্যাঙ্ক, কামান বা পদাতিক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল নয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence), স্বায়ত্তশাসিত ড্রোন, সাইবার যুদ্ধ, মহাকাশ প্রযুক্তি, এবং হাইপারসনিক অস্ত্রের মতো উদীয়মান প্রযুক্তি আধুনিক যুদ্ধের চরিত্র পুনর্নির্ধারণ করছে। এই যুদ্ধক্ষেত্র বহুমাত্রিক, যেখানে স্থল, সমুদ্র, আকাশ, সাইবার এবং মহাকাশ মিলিতভাবে একটি জটিল নেটওয়ার্ক তৈরি করে।
এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারত নিজেকে প্রযুক্তি, কৌশল এবং যৌথ যুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করছে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই নতুন যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, কৌশলগত সংস্কার এবং তিনটি বাহিনীর (সেনা, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী) সমন্বয়ের উপর জোর দিচ্ছে।
ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে এআই-চালিত স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্র, ড্রোন সোয়ার্ম, এবং সাইবার আক্রমণ প্রধান ভূমিকা পালন করবে। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক স্পেকট্রামে নিয়ন্ত্রণ এবং তথ্য যুদ্ধও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া সিরিয়ায় ড্রোন আক্রমণ প্রতিহত করতে উন্নত ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে।
ভারতও এই ধরনের প্রযুক্তির উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও), ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড (বিইএল), এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো এআই, ড্রোন, এবং মহাকাশ-ভিত্তিক ইলেকট্রনিক যুদ্ধ প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করছে।
২০২৫ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী ‘দশকের রূপান্তর’-এর অধীনে রুদ্র ব্রিগেড, ভৈরব ব্যাটালিয়ন, দিব্যাস্ত্র এবং শক্তিবাণ আর্টিলারি ইউনিটের মতো অভিজাত ইউনিট গঠন করছে।
এই ইউনিটগুলো ড্রোন, মিসাইল রেজিমেন্ট এবং বহুমাত্রিক অপারেশনের জন্য প্রস্তুত।ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশল ২০২৫ সালে ইন্টিগ্রেটেড থিয়েটার কমান্ড (আইটিসি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে চলেছে।
এই কাঠামো সেনা, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীকে একক কমান্ডের অধীনে একীভূত করবে, যা ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত, সিয়াচেন থেকে গুজরাট পর্যন্ত পশ্চিমী থিয়েটার কমান্ডের মতো অঞ্চলের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কার্যকর হবে।
এই কাঠামোর লক্ষ্য হলো অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তিনটি বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় জোরদার করা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এআই, হাইপারসনিক সিস্টেম, এবং রোবটিক্সকে আধুনিক যুদ্ধের মূল হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এছাড়া, সাইবার এবং মহাকাশ যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্রে ভারত নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।ইনোভেশনস ফর ডিফেন্স এক্সেলেন্স (আইডিইএক্স) এবং ডিফেন্স টেস্টিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার স্কিম (ডিটিআইএস) ভারতের প্রতিরক্ষা উদ্ভাবন ও গবেষণাকে ত্বরান্বিত করছে।
আইডিইএক্স-প্রাইমের মাধ্যমে স্টার্টআপগুলো ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত তহবিল পাচ্ছে, এবং এসআরআইজেএএন পোর্টালের মাধ্যমে ১০,৯৪০টি পণ্য স্বদেশীকরণের জন্য চিহ্নিত হয়েছে। ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা এআই সংলাপ এবং ওয়ারগেম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ওয়ারডেক) এআই এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সমন্বয়ে সামরিক কৌশল উন্নত করছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাটলফিল্ড সার্ভেলেন্স সিস্টেম (প্রোজেক্ট সঞ্জয়) ৯৫-৯৬% সাফল্য দেখিয়েছে, যা রিয়েল-টাইম যুদ্ধক্ষেত্রের তথ্য সরবরাহ করে।ভারতের ফিউচার রেডি কমব্যাট ভেহিকল (এফআরসিভি) প্রকল্পে এআই, ড্রোন ইন্টিগ্রেশন, এবং অ্যাকটিভ প্রোটেকশন সিস্টেমের মতো প্রযুক্তি সংযোজন করা হচ্ছে।
এই ট্যাঙ্কগুলো নেটওয়ার্ক-কেন্দ্রিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত এবং বহুমাত্রিক হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম। ভারতের সামরিক শিক্ষায়ও পরিবর্তন আসছে। হেডকোয়ার্টার্স ইন্টিগ্রেটেড ডিফেন্স স্টাফ (এইচকিউ আইডিএস) দ্বারা পরিচালিত ‘ফিউচার ওয়ারফেয়ার কোর্স’ এআই, সাইবার হুমকি, এবং মহাকাশ প্রভুত্বের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
এই কোর্সে তিনটি বাহিনী, শিল্প এবং শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে নতুন প্রজন্মের যোদ্ধা তৈরি করা হচ্ছে।ভারত আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমেও প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ফ্রান্সের সঙ্গে এআই এবং প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি নিয়ে অংশীদারিত্ব জোরদার হচ্ছে। তবে, ভারত স্বনির্ভরতার উপর জোর দিয়ে এআই সরঞ্জাম কাস্টমাইজেশন এবং ডেটা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করছে।
এছাড়া, সেন্টার ফর জয়েন্ট ওয়ারফেয়ার স্টাডিজ (সিইএনজেওডব্লিউএস) এবং প্রস্তাবিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি (আইএনডিইউ) যৌথ যুদ্ধ কৌশল এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশল এখন বহুমাত্রিক, নেট-কেন্দ্রিক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে।
বাণিজ্য দ্বন্দ্বের জেরে যুক্তরাষ্ট্রগামী ডাকসেবা সাময়িকভাবে স্থগিত করল ভারত
এআই, রোবটিক্স, এবং সাইবার যুদ্ধের সমন্বয়ে ভারত আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। এই প্রচেষ্টা ভারতকে ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থানে রাখবে।