বিদেশি বিনিয়োগে ভারতের প্রযুক্তি এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি কোম্পানি কাইন্ড্রিল (Kyndryl) নামে পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠান আগামী তিন বছরে ভারতে ২.২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। এই বিনিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হবে বেঙ্গালুরুতে একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) উদ্ভাবন কেন্দ্র স্থাপন। এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কাইন্ড্রিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মার্টিন শ্রোইটার, যিনি ভারত সফরে এসে এই বিনিয়োগের কথা জানিয়েছেন। এই ছবিটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে, যেখানে দুজনের হাত মিলিয়ে ধরা রয়েছে, যেন ভারত-আমেরিকা সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায়ের শুরু।
বিনিয়োগের উদ্দেশ্য ও প্রভাব
কাইন্ড্রিলের এই বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হল ভারতের প্রযুক্তি অবকাঠামোকে আধুনিকীকরণ করা এবং ভবিষ্যৎ প্রস্তুত শ্রমশক্তি গড়ে তোলা। বেঙ্গালুরুতে স্থাপিত এই এআই ল্যাবটি বিশেষভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটা বিশ্লেষণ, ক্লাউড প্রযুক্তি এবং প্ল্যাটফর্ম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দক্ষতা সম্পন্ন পেশাদারদের প্রশিক্ষণ দেবে। এই উদ্যোগটি ভারত সরকারের ‘ইন্ডিয়া এআই মিশন’ এর সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছে। এছাড়া, এই ল্যাবটি গভর্নেন্স, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে উচ্চ প্রভাবশালী প্রকল্প পরিচালনা করবে।
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এই বিনিয়োগের গভীর প্রভাব পড়তে পারে। ২০২৩ সালের একটি ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড সার্ভিসেস কোম্পানি (ন্যাসকম) রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের আইটি খাত বর্তমানে ২৪৫ বিলিয়ন ডলারের বাজারে অংশগ্রহণ করছে, যার ৮.৪% বৃদ্ধি ঘটেছে। বেঙ্গালুরু, যাকে সিলিকন ভ্যালি অফ ইন্ডিয়া বলা হয়, ইতিমধ্যেই দেশের ৩৫% এআই স্টার্টআপের কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হয় (২০২৪ সালের পিডব্লিউসি অধ্যয়ন অনুযায়ী)। কাইন্ড্রিলের এই বিনিয়োগ এই শহরকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলবে এবং চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা ভারতের তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি বড় সুযোগ।
শুল্ক বিতর্কের প্রেক্ষাপট
এই বিনিয়োগের ঘোষণা এসেছে একটি সময়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শুল্ক যুদ্ধ আবার তীব্র হয়ে উঠেছে। ২০২৫ সালে এই বিতর্ক পুনরায় শুরু হওয়ায় মার্কিন কোম্পানিরা চীন থেকে তাদের বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়ে বিকল্প বাজার খুঁজছে। ভারত এই পরিস্থিতিতে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, বিশেষ করে এর সস্তা শ্রমশক্তি এবং ক্রমশ উন্নত হওয়া প্রযুক্তি অবকাঠামোর কারণে। ইতিহাস বলে, ১৯৯০-এর দশকে আইবিএমের মতো কোম্পানির ভারতে প্রবেশের ফলে ১৫০,০০০-এর বেশি চাকরি সৃষ্টি হয়েছিল। কাইন্ড্রিলের বিনিয়োগও এই ধরনের সুফল আনতে পারে, যদি এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়।
সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যমে এই বিনিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতামত প্রকাশ পেয়েছে। কেউ কেউ এটিকে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, যেখানে অন্যরা এটিকে শুধু একটি বড় ঘোষণা মনে করছেন যা বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। কিছু ব্যবহারকারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই বিনিয়োগকে হাস্যকর মেমে দিয়ে উপহাস করেছেন, যেখানে তিনি চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে ভারতের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই বিনিয়োগ ভারতকে গ্লোবাল আইটি অর্ডারে একটি নেতৃত্বদায়ী ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই বিনিয়োগের ফলে ভারতের আইটি খাতে চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং এআই প্রযুক্তিতে দেশের দক্ষতা আরও বাড়বে। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সরকারের আয়োজিত এআই ইমপ্যাক্ট সম্মেলনে কাইন্ড্রিল তার এআই-সমৃদ্ধ কাইন্ড্রিল ব্রিজ প্ল্যাটফর্ম প্রদর্শন করবে, যা গ্লোবাল স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই উদ্যোগটি ভারতকে শুধু ব্যাক অফিস থেকে এআই-চালিত প্রযুক্তি সমাধানের নেতৃত্বে নিয়ে যেতে পারে। তবে, এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আরও নীতিগত সহায়তা এবং শিক্ষাকৌশলের উন্নতি প্রয়োজন হবে।
সারাংশে বলা যায়, কাইন্ড্রিলের এই ২.২৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ শুল্ক বিতর্কের মাঝে ভারতের জন্য একটি সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নয়, বরং প্রযুক্তি ও শিক্ষা খাতে একটি নতুন যুগের সূচনা হতে পারে। ভারতের এই সুযোগটি কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবে, তা আগামী দিনের পরীক্ষা।