ভারতে বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) শিল্পে আরও গতি আনতে কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি ‘পিএম ই-ড্রাইভ’ (PM E-Drive)প্রকল্পকে দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৭-২৮ পর্যন্ত চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বৈদ্যুতিক বাস, ট্রাক এবং চার্জিং অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে ই-রিকশা সংক্রান্ত লক্ষ্য ও আর্থিক বরাদ্দে বড়সড় সংশোধন এনেছে কেন্দ্র।
ভারী শিল্প মন্ত্রক ১৩ আগস্ট এক সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ই-রিকশার জন্য প্রকল্পে নির্ধারিত বরাদ্দ ১৯২ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ কোটি টাকায় আনা হয়েছে। অন্যদিকে, যাত্রী ও পণ্যবাহী বৈদ্যুতিক তিন-চাকা (এল৫ ক্যাটাগরি) যানবাহনের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পূর্বে যেখানে ৭১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫৭ কোটি টাকা।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ই-রিকশা বিভাগে প্রত্যাশিত সাড়া মেলেনি। এখন পর্যন্ত মাত্র ৪,০০০-এর কিছু বেশি ই-রিকশা বিক্রি হয়েছে, যেখানে লক্ষ্য ছিল ১.১০ লক্ষেরও বেশি। এর ফলে লক্ষ্য কমিয়ে আনতে হয়েছে। নতুন বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, সরকার ই-রিকশার জন্য ৪০,০০০ ইউনিট পর্যন্ত প্রণোদনা দেবে, অন্যদিকে এল৫ ক্যাটাগরির তিন-চাকার যানবাহনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে প্রায় ২.৮৮ লক্ষ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-রিকশার মূল সমস্যাটি হলো দেশীয় উপাদান ব্যবহার বা লোকালাইজেশন নীতি। ভারতীয় তৈরি মোটরের দাম প্রায় ₹১৫,০০০, যেখানে আমদানিকৃত সস্তা মোটর অনেক কম দামে পাওয়া যায়। সরকার প্রতিটি ই-রিকশার জন্য ₹১০,০০০-₹১২,০০০ পর্যন্ত ভর্তুকি দিচ্ছে, কিন্তু তা দিয়ে ব্যবসায়ীদের লাভজনক অবস্থান তৈরি হচ্ছে না। ফলে বহু সংস্থা বাজারে প্রবেশ করতে আগ্রহী হচ্ছে না।
ইয়াত্রী ই-রিকশার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পবন কক্কর বলেন, “ই-রিকশা সেগমেন্টের জন্য সরকারের উদ্দেশ্য ভালো হলেও লোকালাইজেশনের কারণে আসল উপকার পাচ্ছে কিছু বড় সংস্থা। সাধারণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনা যথেষ্ট কার্যকর নয়।”
তবুও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পরিবেশবান্ধব পরিবহণের ক্ষেত্রে ই-রিকশার গুরুত্ব অপরিসীম। দিল্লির মতো শহরে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী মেট্রো স্টেশন থেকে গন্তব্যে পৌঁছাতে ই-রিকশার উপর নির্ভর করেন। শুধু পরিচ্ছন্ন পরিবহণই নয়, ই-রিকশা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
সিএইউটিএস (CUTS) সংস্থার ২০২৪ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, “ই-রিকশা শেষ মাইল সংযোগের জন্য একটি স্বল্পমূল্যের এবং পরিচ্ছন্ন সমাধান, যা একইসঙ্গে উদ্যোক্তা সৃষ্টিতেও সাহায্য করছে।” তবে সমীক্ষায় এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে অস্পষ্ট নিয়মনীতি এই ক্ষেত্রে নতুন অংশগ্রহণকারীদের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাইসেন্স, পারমিট ও কার্যক্রম সংক্রান্ত নিয়মে স্বচ্ছতা না থাকায় অনেক সময় ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তায় পড়েন।
ই-রিকশা নিয়ে চ্যালেঞ্জ থাকলেও, সরকারের প্রধান দৃষ্টি এখন বৈদ্যুতিক বাস, ট্রাক ও চার্জিং অবকাঠামো নির্মাণের দিকে। প্রকল্পে এ তিন খাতের জন্য বরাদ্দ মোট ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি। বৈদ্যুতিক বাসের জন্য বরাদ্দ ৪,৩৯১ কোটি টাকা, বৈদ্যুতিক ট্রাকের জন্য ৫০০ কোটি টাকা এবং চার্জিং অবকাঠামোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২,০০০ কোটি টাকা।
তবে এত বড় বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত এই খাতে তেমন অর্থ ছাড় হয়নি। ফলে সরকার প্রকল্পকে আরও দুই বছর বাড়িয়ে এ খাতে বাস্তবায়ন জোরদার করতে চাইছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ‘পিএম ই-ড্রাইভ’ প্রকল্পকে অনুমোদন দেয়। এর আগে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২৩-২৪ পর্যন্ত দুটি ধাপে ‘ফেম’ (FAME: Faster Adoption and Manufacturing of Electric and Hybrid Vehicles) প্রকল্প চালু ছিল।
ফেম-২ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০২৪ সালের মার্চে সরকার অস্থায়ীভাবে ‘ইলেকট্রিক মোবিলিটি প্রমোশন স্কিম’ (EMPS) চালু করে। পরে তা একীভূত হয়ে যায় ‘পিএম ই-ড্রাইভ’ প্রকল্পে।
শিল্পমহল মনে করছে, প্রকল্পের সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলির মধ্যে ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমন কিছু চ্যালেঞ্জও থেকে যাচ্ছে। একদিকে, এল৫ তিন-চাকার জন্য বরাদ্দ ও লক্ষ্য বাড়ানো সঠিক পদক্ষেপ, কারণ এ খাতে বাজার চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। অন্যদিকে, ই-রিকশার লক্ষ্য কমানো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এখনো নীতি ও বাস্তবায়নে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে।
সামগ্রিকভাবে, কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত ভারতকে পরিচ্ছন্ন শক্তিনির্ভর পরিবহণে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ই-রিকশার জন্য সঠিক প্রণোদনা কাঠামো তৈরি হলে এবং নিয়মের স্বচ্ছতা বাড়ানো গেলে, এটি শহর ও গ্রামীণ দুই জায়গাতেই শেষ মাইল সংযোগে এক বিপ্লব ঘটাতে পারে। আর বাস, ট্রাক ও চার্জিং অবকাঠামোতে বিনিয়োগ দেশকে বৈদ্যুতিক পরিবহণের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মানচিত্রে শীর্ষে তুলতে সাহায্য করবে।