শুক্রবার সকাল ১১:৪৩টায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এম্মানুয়েল ম্যাক্রঁ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক (India-France Trade) আরও গাঢ় করার একটি বড় ঘোষণা দিয়েছেন। এই ঘোষণা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, বিশেষ করে যখন আমেরিকা নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিরা তাদের বাণিজ্য নীতিতে একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে চাপ সৃষ্টি করছে। ফ্রান্সের এই পদক্ষেপটি শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি নতুন অধ্যায়ই শুরু করে না, বরং একটি ভূ-রাজনৈতিক পুনর্স্থাপনার ইঙ্গিতও দেয়, যা ভারত ও ইউরোপীয় সংঘের মধ্যে সামঞ্জস্য বৃদ্ধির দিকে নির্দেশ করে।
ফ্রান্সের সিদ্ধান্তের পটভূমি
ফ্রান্সের এই ঘোষণা আসছে এমন সময়ে, যখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর শুল্ক বৃদ্ধি করেছে, যা প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই পদক্ষেপটি ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে, তবে এটি একই সঙ্গে ভারতকে বিকল্প বাজার খুঁজতে উৎসাহিত করেছে। ফ্রান্স এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হলো ভারতের বিশাল বাজারে প্রবেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ফ্রান্সের প্রভাব বাড়ানো।
পররাষ্ট্রীয় সূত্রের অভিযোগ, ফ্রান্সের এই কৌশলটি মাত্র অর্থনৈতিক স্বার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, এটি একটি বড় ভূ-রাজনৈতিক রাজনীতির অংশ, যেখানে ফ্রান্স চায় যে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের বিকল্প হিসেবে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর (আইএমইসি) তৈরি করা। এই করিডরটি ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে মোদীর ভারত সফরের সময় প্রস্তাবিত হয়েছিল, যা ইউরোপ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যের একটি নতুন পথ খুলে দেবে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিস্তার
আইবিইএফ-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত ও ফ্রান্সের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১৩.৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা গত পাঁচ বছরে স্থির প্রগতির একটি প্রমাণ। ভারতের রপ্তানি ফ্রান্সে ২০১৮-১৯ সালে ৫.২৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২২-২৩ সালে ৭.৬১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এই বৃদ্ধি ঘটেছে আইটি, স্বাস্থ্য গবেষণা এবং পর্যটন খাতে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের ফলে, যা ২০২২ সালে শুরু হয়েছিল।
ফ্রান্সে বর্তমানে ১৫০টিরও বেশি ভারতীয় কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং এগুলো প্রায় ৭,০০০ জনকে চাকরি দিয়েছে। এই সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে, কারণ ফ্রান্স গভর্নমেন্ট-টু-গভর্নমেন্ট এবং ব্যবসা-টু-ব্যবসা সহযোগিতাকে আরও জোর দেবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের তরুণ শ্রমশক্তি ও ফ্রান্সের প্রযুক্তিগত দক্ষতার সমন্বয় এই সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করবে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
এই বাণিজ্য বৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক কারণও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কে বিষণ্ণতার মধ্যে ভারত বিকল্প সঙ্গী খুঁজছে, এবং ফ্রান্স এই ফাঁকটি পূরণ করতে প্রস্তুত। মোদি ও ম্যাক্রঁ-এর সাম্প্রতিক টেলিফোন কথোপকথনে জোর দেওয়া হয়েছে যে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এই সহযোগিতা অপরিহার্য। তাদের আলোচনায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তাও উঠে এসেছে।
একই সঙ্গে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার নিয়ে ভারত ও ফ্রান্সের অবস্থান একরৈখিক। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের একটি যৌথ বিবৃতিতে ভারতের স্থায়ী সদস্যতার সমর্থন প্রকাশ করা হয়েছিল। এই পটভূমিতে, ফ্রান্সের ২০২৬ সালে জি৭ প্রেসিডেন্সি ও ভারতের বিআরআইসিএস প্রেসিডেন্সির জন্য কাছাকাছি কাজ করার পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের দৃষ্টিকোণ
ভারতের দিক থেকে, ফ্রান্সের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি তার ‘আত্মনির্ভর ভারত’ অভিযানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভারতীয় রপ্তানিকার্মীরা নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারবে, যা আমেরিকার শুল্কবৃদ্ধির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। এছাড়া, ফ্রান্সের প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ ভারতের উন্নয়ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
তবে, এই সহযোগিতার পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ভিন্ন বাণিজ্য নীতি, শ্রম আইন এবং পরিবেশগত মান পূরণের বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা প্রয়োজন। তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, উভয় দেশের রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি এই বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করবে।
সামগ্রিকভাবে, ফ্রান্সের এই ঘোষণা ভারত-ফ্রান্স সম্পর্কে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা দেবে না, বরং একটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করবে, যা বিশ্বে ভারতের প্রভাব বাড়াবে। আমেরিকার চাপের মধ্যেও ভারতের এই বিকল্প পথ খুঁজার ক্ষমতা তার বৈশ্বিক স্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।