অমর্ত্য সেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্ববিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, ফের একবার রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এলেন তাঁর সাম্প্রতিক মন্তব্যকে ঘিরে। বাংলাভাষা, পরিচয় রাজনীতি এবং ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়া নিয়ে তাঁর বক্তব্য ইতিমধ্যেই চর্চার ঝড় তুলেছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে—বাংলায় কথা বললেই মানুষকে বাংলাদেশি বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ নিয়েই অমর্ত্য সেনের তীব্র কটাক্ষ রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
অমর্ত্য সেন বলেন, “বাংলায় কথা বললেই নাকি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি ফরাসি জানি না। তাহলে কি আমাকে ফ্রান্সে পাঠিয়ে দেওয়া হবে?” তাঁর এই ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য কেবলমাত্র রাজনৈতিক ইঙ্গিত নয়, বরং পরিচয় সংকট এবং ভাষার ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টির প্রবণতাকেও সামনে নিয়ে এল। তিনি আরও বলেন, “আমাকে বাংলাদেশে পাঠানো হলে আমার আপত্তি নেই। কারণ ঢাকাতেই আমার বাড়ি ছিল।” তাঁর শৈশব এবং পারিবারিক শিকড় বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকায় এই মন্তব্য স্বাভাবিক হলেও, প্রেক্ষিত রাজনৈতিক হওয়ায় তা নতুন মাত্রা দিয়েছে।
তৃণমূলের অভিযোগ, বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্র এবং কয়েকটি রাজ্যে পরিকল্পিতভাবে বাংলাভাষী মানুষকে সন্দেহজনক নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। বিশেষত, ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়া (SIR) নিয়ে তাঁদের প্রশ্ন—এটি কি নাগরিকত্বের নামে নতুন বিভাজনের অস্ত্র হতে চলেছে? নাগরিকপঞ্জি (NRC) এবং জাতীয় নাগরিকত্ব আইন (CAA) ইস্যু নিয়েই পশ্চিমবঙ্গ সহ সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল বহু দিন ধরেই উত্তপ্ত। তার মধ্যেই বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি আখ্যা দেওয়ার প্রবণতা নিয়ে তৃণমূল সরব হয়েছে।
অমর্ত্য সেনের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তিনি এই প্রবণতাকে শুধু রাজনৈতিক কৌশল নয়, বরং সামাজিক বিভাজনের জন্যও দায়ী করছেন। ভাষা কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে আটকে রাখা যায় না—এ কথা তিনি বহুবার বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলেছেন। বাংলা ভাষা আজ বিশ্বজোড়া মানুষের, কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অথচ রাজনৈতিক লাভের জন্য এই ভাষাভাষীদের বারবার ‘বিদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়।
অর্থনীতির পাশাপাশি অমর্ত্য সেন সবসময় মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায় এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে স্পষ্টভাষী। তাঁর মতে, গণতন্ত্র কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বাধীন মতপ্রকাশ গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। সেই জায়গা থেকেই তিনি ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়াকেও প্রশ্নের মুখে তুলেছেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বহু প্রকৃত ভোটার হয়রানির শিকার হবেন কি না, সেই আশঙ্কা থেকেই তাঁর সরব হওয়া।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, অমর্ত্য সেনের মন্তব্য নিছক ব্যক্তিগত নয়। এটি নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে একটি সতর্কবার্তা। বাংলার সাংস্কৃতিক পরিসরে ভাষা নিয়ে যে গর্ব এবং সংবেদনশীলতা রয়েছে, সেখানে বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা ক্ষোভের জন্ম দেবে, তা সহজেই অনুমেয়।
তৃণমূল কংগ্রেস অমর্ত্য সেনের মন্তব্যকে হাতিয়ার করে কেন্দ্রকে আক্রমণ জোরদার করবে বলেই মনে করা হচ্ছে। বিজেপির তরফে অবশ্য ইতিমধ্যেই সাফাই দেওয়া হচ্ছে যে, বিষয়টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রচার করা হচ্ছে। তবে জনমানসে সন্দেহ ও ক্ষোভ তৈরি হয়ে গেলে তা সামলানো সহজ হবে না।
সারকথা, অমর্ত্য সেনের ব্যঙ্গাত্মক অথচ তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন আলো ফেলল। ভাষা, পরিচয়, নাগরিকত্ব এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা কেবল বাংলায় নয়, গোটা দেশেই এক বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলার মানুষের কাছে বাংলা ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, আত্মপরিচয়ের প্রতীক। সেই ভাষার মর্যাদা এবং ভাষাভাষীদের অধিকার রক্ষায় অমর্ত্য সেনের কণ্ঠস্বর নিঃসন্দেহে আন্দোলনের সুরে প্রতিধ্বনিত হবে।