কৃষকদের জন্য মধ্যস্থতাকারীদের সমস্যায় e-NAM এবং এফপিও কীভাবে সমাধান দিচ্ছে

ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরেই কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন, কারণ মধ্যস্থতাকারীরা বাজারে তাদের…

How e-NAM and FPOs Empower Farmers to Bypass Middlemen and Boost Profits

ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা দীর্ঘদিন ধরেই কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন, কারণ মধ্যস্থতাকারীরা বাজারে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের স্বাবলম্বী করতে এবং তাদের আয় বাড়াতে ভারত সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ—ই-ন্যাম (e-NAM-ইলেকট্রনিক ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট) এবং এফপিও (ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই দুটি উদ্যোগের মাধ্যমে কীভাবে কৃষকরা মধ্যস্থতাকারীদের এড়িয়ে ন্যায্য মূল্য পেতে পারেন, তা বিশ্লেষণ করব।

Also Read | বদলে গিয়েছে চাষের ধরন! আম উৎপাদনে নয়া রেকর্ড ভারতের

   

মধ্যস্থতাকারীদের সমস্যা
ভারতের কৃষি বাজারে মধ্যস্থতাকারী বা দালালরা কৃষক ও ভোক্তাদের মাঝে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষকরা তাদের ফসল বিক্রি করতে গিয়ে প্রায়ই এই মধ্যস্থতাকারীদের উপর নির্ভর করেন, যারা ফসলের মূল্য নির্ধারণে নিয়ন্ত্রণ রাখেন। ফলে, কৃষকরা তাদের উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম মূল্য পান, আর ভোক্তারা বাজারে বেশি দাম দিয়ে ফসল কিনতে বাধ্য হন। এই অসমতার কারণে কৃষকদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়, এবং কৃষি পেশা অনেকের কাছে অলাভজনক হয়ে ওঠে।

এই সমস্যার সমাধানে ভারত সরকার ২০১৬ সালে ই-ন্যাম প্ল্যাটফর্ম চালু করে, যা কৃষকদের সরাসরি বাজারের সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করে। পাশাপাশি, এফপিও-এর মাধ্যমে কৃষকদের একটি সংগঠিত কাঠামোর আওতায় আনা হচ্ছে, যাতে তারা সম্মিলিতভাবে বাজারে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে।

ই-ন্যাম: কৃষকদের জন্য ডিজিটাল বিপ্লব
ই-ন্যাম হল একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, যা ভারতের বিভিন্ন কৃষি বাজারকে একটি একক নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে এসেছে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফসল সরাসরি অনলাইনে বিক্রি করতে পারেন, যা তাদের মধ্যস্থতাকারীদের উপর নির্ভরতা কমায়। ই-ন্যামের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফসলের মূল্য, বাজারের চাহিদা এবং ক্রেতাদের তথ্য সহজেই জানতে পারেন। এই প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধিত কৃষকরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন, যার ফলে তারা তাদের ফসলের জন্য ন্যায্য মূল্য পান।

Also Read | সবজি উৎপাদনে ভারতের মধ্যে দ্বিতীয় পশ্চিমবঙ্গ

ই-ন্যামের আরেকটি বড় সুবিধা হল এর স্বচ্ছতা। এই প্ল্যাটফর্মে ফসলের গুণমান পরীক্ষা, মূল্য নির্ধারণ এবং লেনদেনের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়। ফলে, কৃষকরা তাদের ফসলের জন্য সঠিক মূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তা পান। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের মালদা বা মুর্শিদাবাদের কৃষকরা তাদের আম, লিচু বা ধান ই-ন্যামের মাধ্যমে সরাসরি বিক্রি করে উচ্চ মূল্য পেতে পারেন। এছাড়াও, ই-ন্যাম কৃষকদের জন্য পরিবহন ও লজিস্টিক সুবিধা প্রদান করে, যা তাদের বাজারে প্রবেশকে আরও সহজ করে।

Advertisements

এফপিও: কৃষকদের সম্মিলিত শক্তি
ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (এফপিও) হল কৃষকদের একটি সমবায় কাঠামো, যেখানে তারা একত্রে এসে তাদের উৎপাদন, বিপণন এবং বিক্রয় প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। এফপিও-এর মাধ্যমে কৃষকরা একটি সংগঠিত দল হিসেবে কাজ করে, যা তাদের বাজারে দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়ায়। এই সংগঠনগুলি কৃষকদের জন্য বীজ, সার, যন্ত্রপাতি এবং ঋণের সুবিধা প্রদান করে, যা তাদের উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করে।

এফপিও-এর মাধ্যমে কৃষকরা তাদের ফসলের মূল্য সংযোজন (ভ্যালু অ্যাডিশন) করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, শুধু কাঁচা ফসল বিক্রির পরিবর্তে তারা ফসল প্রক্রিয়াজাত করে (যেমন, ফলের জ্যাম, আচার বা শুকনো ফল) বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করতে পারেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়, যেমন বাঁকুড়া বা পুরুলিয়ায়, এফপিও-এর মাধ্যমে কৃষকরা তাদের সবজি, ফল বা শস্য সরাসরি বাজারে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। এছাড়া, এফপিও কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির সুবিধা প্রদান করে, যা তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ায়।

পশ্চিমবঙ্গে ই-ন্যাম ও এফপিও-এর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতিতে ই-ন্যাম ও এফপিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় কৃষকরা এই প্ল্যাটফর্মের সুবিধা গ্রহণ করে তাদের আয় বাড়াচ্ছেন। উদাহরণস্বরূপ, নদিয়া জেলার কৃষকরা ই-ন্যামের মাধ্যমে তাদের সবজি ও ফুল সরাসরি কলকাতার বাজারে বিক্রি করছেন। একইভাবে, উত্তর দিনাজপুরের কৃষকরা এফপিও-এর মাধ্যমে তাদের ধান ও আনারস প্রক্রিয়াজাত করে বাজারে বিক্রি করছেন। এই উদ্যোগগুলি কৃষকদের মধ্যস্থতাকারীদের উপর নির্ভরতা কমিয়ে তাদের আর্থিক স্বাধীনতা দিচ্ছে।

তবে, এই উদ্যোগগুলির সফলতার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। অনেক কৃষক এখনও ই-ন্যামের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে দক্ষতার অভাবে পিছিয়ে রয়েছেন। এছাড়া, এফপিও গঠন ও পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার প্রয়োজন। সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে এই দিকে আরও মনোযোগ দিতে হবে।

ই-ন্যাম এবং এফপিও ভারতের কৃষকদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই উদ্যোগগুলি কৃষকদের মধ্যস্থতাকারীদের শোষণ থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের সরাসরি বাজারের সঙ্গে যুক্ত করছে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ, যা তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারে। তবে, এই উদ্যোগগুলির পূর্ণ সাফল্য নির্ভর করছে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপর। সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং কৃষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভারতের কৃষি ব্যবস্থা একটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে।