আজ থেকে ২০ বছর আগে যদি কেউ বলত যে ভারত আমের উৎপাদনে (Mango Production) দ্বিগুণ অঙ্কে বৃদ্ধি করবে, তবে সেটি হয়তো কল্পনার বাইরে মনে হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই কল্পনা বাস্তবে পরিণত হয়েছে। কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (MoA&FW) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ২০ বছরে ভারতের আম উৎপাদনে ১০০% বৃদ্ধি ঘটেছে। ২০০৪ সালে ১১৪.৯০ হাজার মেট্রিক টন থেকে শুরু করে ২০২৫ সালে এটি বেড়ে ২২৮.৩৭ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছেছে। এই অসাধারণ প্রগতি কেবল সংখ্যার খেলা নয়, বরং এটি আমাদের কৃষি পদ্ধতিতে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের একটি প্রতিফলন।
আম উৎপাদনে ভারতের অগ্রগতি
২০০৪ সালে ১১৪.৯০ হাজার মেট্রিক টন থেকে শুরু করে ২০১০ সালে ১৫০.২৭ হাজার মেট্রিক টনে, তারপর ২০১৬ সালে ১৮৬.৪২ হাজার মেট্রিক টনে এবং ২০২০ সালে ২০৩.১৭ হাজার মেট্রিক টনে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এবার ২০২৫ সালে এই সংখ্যা ২২৮.৩৭ হাজার মেট্রিক টনে পৌঁছেছে, যা আমাদের কৃষি খাতে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে গণ্য হচ্ছে। এই বৃদ্ধির পেছনে কেবল প্রাকৃতিক সুবিধা নয়, বরং আধুনিক প্রযুক্তি ও সরকারি উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
উত্তর প্রদেশের অগ্রণী ভূমিকা
ভারতের আম উৎপাদনে উত্তর প্রদেশ রাজ্যটি সর্বাধিক অবদান রাখছে। এই রাজ্যের উপযুক্ত উপউষ্ণকটিবদ্ধ আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণ আমের জন্য আদর্শ। বিশেষ করে দশহরি, লাঙ্গড়া ও চৌসা জাতের আম এখানে উৎপাদিত হয়, যা দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজারে বড় চাহিদার মুখর। জাতীয় বাগানতত্ত্ব বোর্ড (NHB) এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ১০০০ এর বেশি আমের জাতের মধ্যে উত্তর প্রদেশ সর্বাধিক জনপ্রিয় জাতগুলোর উৎপাদনে অগ্রণী।
প্রযুক্তির ভূমিকা
আম উৎপাদনে এই বিপ্লবী পরিবর্তনের পেছনে প্রযুক্তির অবদান অস্বীকার্য। ২০২৫ সালে স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি, যেমন আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা পরিমাপক IoT সেন্সর এবং AI-ভিত্তিক ফসল পর্যবেক্ষণ, কৃষকদের জন্য একটি গেম চেঞ্জার হয়ে উঠেছে। ফার্মোনট নামক একটি প্রতিষ্ঠানের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫ সালে কৃষি অনুদানের ৭০% আবেদন স্মার্ট প্রযুক্তির সামগ্রিক ব্যবহারে নির্দেশিত হয়েছে। এই প্রযুক্তিগুলো কৃষকদের ফসলের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করছে এবং পানির ব্যবহার ও উর্বরকরণে দক্ষতা আনছে।
সরকারি উদ্যোগ ও সহযোগিতা
সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, যেমন প্রিসিশন ইরিগেশন এবং পোস্ট-হারভেস্ট ম্যানেজমেন্টে বিনিয়োগ, আম উৎপাদনে এই বৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এছাড়া, এপিডা (APEDA) এবং মহারাষ্ট্র স্টেট অ্যাগ্রিকালচারাল মার্কেটিং বোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আমের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, মহামঙ্গো ও ম্যাঙ্গ্রো নামক সহযোগী সমিতিগুলো আলফনসো ও কেসর জাতের আম রপ্তানি বাড়াতে সাফল্য অর্জন করেছে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
এই উৎপাদন বৃদ্ধি ভারতের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আম রপ্তানি ২০০২-০৩ সালে ৪৫ হাজার টনে ছিল, যা বর্তমানে অনেক বেশি। এটি কৃষকদের আয় বাড়িয়েছে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। তবে, এই সাফল্যের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও পোকামাকড়ের আক্রমণের মতো সমস্যা উৎপাদনকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
ভারতের আম উৎপাদনে এই বৃদ্ধি একটি শুরু মাত্র। ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি, যেমন জিন-সম্পাদনা এবং স্থানীয় ফসল বৈচিত্র্য বাড়ানো, উৎপাদন ক্ষমতাকে আরও উন্নত করতে পারে। সরকার ও ব্যবসায়ীদের যৌথ প্রচেষ্টায় ভারত বিশ্ব আম বাজারে আরও শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে পারে।
সুতরাং, আম উৎপাদনে ভারতের এই নতুন রেকর্ড কেবল একটি সাফল্যের গল্প নয়, বরং এটি আমাদের কৃষি খাতে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের প্রমাণ। ২০২৫ সালে আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি, সেখান থেকে ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি আমরা প্রযুক্তি ও টেকসই কৃষি পদ্ধতির পথে এগিয়ে যাই।