বাংলার তাঁত শিল্প যা দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির একটি অপরিহার্য অংশ এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি প্রতীক, সাম্প্রতিক সময়ে একটি আকর্ষণীয় তথ্য উন্মোচিত করেছে। চতুর্থ অখিল ভারত তাঁত গণনা (২০১৯-২০) অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে তাঁত শিল্পের একটি গভীর ঐতিহ্য রয়েছে এবং যেখানে তাঁতি সম্প্রদায়ের (Handloom Workers) অবদান অতুলনীয়, তার তাঁত শিল্পকর্মীদের সংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, প্রথম স্থানটি দখল করেছে অসম—একটি অবাঙালি রাজ্য। অসমে ১২ লক্ষ ৮৩ হাজার ৮৮১ জন তাঁত শিল্পকর্মী রয়েছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে এই সংখ্যা ৬ লক্ষ ৩১ হাজার ৪৪৭ জন। এই তথ্য বাংলার তাঁত শিল্পের গৌরবের পাশাপাশি অসমের শিল্পের বৈচিত্র্য ও প্রভাবকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।
অসমের শিল্পের গল্প
অসমের তাঁত শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সোলাকুচি গ্রাম দীর্ঘদিন ধরে রেশম বয়নের জন্য বিখ্যাত। এই গ্রামটি ১৭শ শতাব্দীতে আহোম রাজাদের আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তাঁতি সম্প্রদায়ের হাতে এই শিল্প ফুটে উঠেছে। অসমীয়া রেশম, বিশেষ করে মুগা ও এরি রেশম, যা অসমে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, এই রাজ্যকে তাঁত শিল্পে অগ্রণী করে তুলেছে। মুগা রেশমটি এমন একটি অসাধারণ উপাদান যা স্বর্ণের মতো চকচকে এবং স্থিতিশীল, যা বৈশ্বিক বাজারেও দাবি পেয়ে থাকে। চতুর্থ তাঁত গণনা অনুযায়ী, অসমে ১০.৯ লক্ষ তাঁত বয়নকারী পরিবার রয়েছে, যা দেশের মোট তাঁত পরিবারের এক বড় অংশ। এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, অসমের তাঁত শিল্প শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়, গুণের দিকেও অবিস্মরণীয়।
পশ্চিমবঙ্গের অবদান
পশ্চিমবঙ্গের তাঁত শিল্পের কথা বলতে গেলে শান্তিনিকেতনের বালুচরি শাড়ি, মুর্শিদাবাদের জামদানি, এবং হুগলির তাঁতের কাজের কথা মনে পড়ে। এই শিল্পে প্রায় ৩.৪ লক্ষ পরিবার জড়িত, এবং মোট ৬.৩১ লক্ষ শিল্পকর্মী রয়েছে। বাংলার তাঁত শিল্পে মহিলাদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য, যেহেতু দেশব্যাপী তাঁত শিল্পকর্মীদের ৭২.২৯% মহিলা, এবং এর এক বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসে। তবে, অসমের তুলনায় বাংলার সংখ্যা কম হওয়ায় এই শিল্পের সামনে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যান্ত্রিক কারখানা এবং পাওয়ারলুম শিল্পের প্রভাবে বাংলার তাঁতি সম্প্রদায়ের আর্থিক সংকট বাড়ছে, যা তাদের পেশা ছেড়ে চাকরি খুঁজতে বাধ্য করছে।
তাঁত শিল্পের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
তাঁত শিল্প একটি পরিবেশবান্ধব এবং কম মূলধনের শিল্প হলেও, এটি আধুনিক প্রযুক্তির সামনে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। পাওয়ারলুম এবং যান্ত্রিক টেক্সটাইল শিল্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাঁত শিল্পকর্মীদের জীবিকা উপর প্রভাব ফেলছে। তবে, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ, যেমন দক্ষতা উন্নয়ন প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য ও জীবন বীমা সুবিধা, এবং আর্থিক সহায়তা, এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। অসমে সরকারি উৎসাহ এবং স্থানীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহার তাঁত শিল্পের বৃদ্ধির একটি মডেল হতে পারে, যা পশ্চিমবঙ্গও অনুসরণ করতে পারে।
ভবিষ্যতের দিকে
অসমের শীর্ষস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় স্থান থেকে বোঝা যায় যে, তাঁত শিল্প এখনও ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির একটি শক্তিশালী ভিত্তি। তবে, এই শিল্পের টিকে থাকতে হলে স্থানীয় শিল্পকর্মীদের প্রশিক্ষণ, বাজারে বৈচিত্র্যময় পণ্যের প্রচার, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ বাড়াতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের তাঁতি সম্প্রদায়কে অসমের মতো সরকারি সহায়তা এবং ঐতিহ্যকে আধুনিকতার সঙ্গে মিশিয়ে চলতে হবে। এর ফলে বাংলার তাঁত শিল্প আবারও আগেকার গৌরব ফিরে পেতে পারে।
সুতরাং, অসমের শীর্ষস্থান এবং বাংলার দ্বিতীয় স্থান এই শিল্পের বিভিন্ন রূপ ও সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে। এই দুই রাজ্যের তাঁত শিল্পের গল্প হলো একটি ঐতিহ্যের গল্প, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং ভবিষ্যতের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে।