২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যজুড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম প্রচার ছিল ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ (Lakshmir-bhandar) প্রকল্প। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রাজ্যের নারীদের আর্থিক সুরক্ষার জন্য প্রতি মাসে তাঁদের হাতে পৌঁছে যাবে ভাতা। এই প্রতিশ্রুতি ছিল নির্বাচনী কৌশলের অন্যতম বড় হাতিয়ার। নির্বাচনের ফলাফলেও দেখা গিয়েছিল, বাংলার নারী ভোটারদের একটি বড় অংশ তৃণমূলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তৃণমূলের বিপুল সাফল্যের অন্যতম ভিত্তি ছিল এই প্রকল্পের জনপ্রিয়তা।
কিন্তু সম্প্রতি রাজ্যের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহর মন্তব্যে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মহিষাদল ব্লকের নাটশাল-১ ও নাটশাল-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের দুটি ‘আমাদের পাড়া, আমাদের সমাধান’ শিবিরে গিয়ে তিনি বলেন,(Lakshmir-bhandar) “দিদি মহিলাদের কথা ভেবেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প চালু করেছিলেন। প্রথমে দেওয়া হয়েছিল ৫০০/১০০০ টাকা, পরে তা বাড়িয়ে ১০০০/১২০০ টাকা করা হয়েছে। মহিলারা এই টাকা পেয়ে ভোটের দিনে টোটো বা অটো ভাড়া করে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দিদিকে ভুলে গিয়ে অন্য ফুলে ভোট দিচ্ছেন।”
এই মন্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে জোর জল্পনা। প্রশ্ন উঠছে—তাহলে কি ‘ক্যাশ পলিটিক্স’ বা নগদ ভাতা দেওয়ার কৌশল আর আগের মতো কার্যকরী থাকছে না? রাজ্যের মহিলারা কি সত্যিই ভাতা পেয়ে শাসকদলের প্রতি ভোটবাক্সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন না?
তৃণমূল শিবিরের একাংশের মতে, এই ধরনের মন্তব্য আসলে ক্ষোভ প্রকাশ। কারণ রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভোট শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সুবিধার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় না। গ্রামীণ মহিলাদের একাংশ হয়তো প্রকল্পের সুবিধা পেলেও স্থানীয় স্তরে অন্যান্য সমস্যা, যেমন—চাকরির অভাব, দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো—এসব বিষয়েও তাঁরা ভোটের দিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ফলে ভাতা পেলেও সব ভোট তৃণমূলের ঝুলিতে যাচ্ছে না।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার তৃণমূলকে একপ্রকার ‘গেমচেঞ্জার’ সুবিধা দিয়েছিল। বাংলার নারীরা তখন মনে করেছিলেন, এই ভাতা তাঁদের সংসারের খরচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাশাও বেড়েছে। শুধুমাত্র মাসে হাজার টাকা পেয়ে মহিলাদের একাংশ হয়তো সন্তুষ্ট নন। তাঁরা এখন চাকরি, উন্নত শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো বিষয়কেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। ফলে শুধু নগদ অর্থ নয়, সার্বিক উন্নয়নই ভোট নির্ধারণে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে।
এর আগেও প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন তৃণমূলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায়। তিনি বলেছিলেন, “গ্রামের মহিলারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের জন্য আমাদের ভোট দিয়েছেন। কিন্তু শহরের ফ্ল্যাটবাড়ির মহিলারা আমাদের ভোট দেননি।” তাঁর এই মন্তব্যেও রাজনৈতিক আলোচনায় উঠেছিল নারী ভোটের ভিন্নতর মানসিকতা। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে ভাতা অনেক বেশি কার্যকর হলেও শহুরে নারীরা সম্ভবত তা দিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন না।
উদয়ন গুহর সাম্প্রতিক মন্তব্য আবারও ইঙ্গিত দিচ্ছে, রাজ্যের শাসকদল ভেতরেই একটি চাপা অস্বস্তি রয়েছে। রাজনীতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সহায়তার উপর নির্ভর করে না। ভোটাররা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও সচেতন হচ্ছেন। প্রকল্পের সুবিধা পেলেও ভোট দেওয়ার সময় তাঁরা সরকারের সামগ্রিক কাজের হিসেব কষে নিচ্ছেন।
তবে বিরোধীদের দাবি, শাসকদল শুরু থেকেই বুঝেছিল নগদ ভাতার প্রলোভন দেখিয়ে নারী ভোট ব্যাংককে আঁকড়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে মহিলারা তাঁদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সেই কারণেই তৃণমূলের নেতারা এখন এ ধরনের ক্ষোভপ্রকাশ করছেন।
সব মিলিয়ে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার (Lakshmir-bhandar) নিয়ে এই বিতর্ক আবারও সামনে আনল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— বাংলার ভোট রাজনীতিতে ‘ক্যাশ পলিটিক্স’ কতটা কার্যকরী? হয়তো প্রকল্পের তাৎক্ষণিক প্রভাব ছিল বিশাল, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা ভোটারদের আস্থা ধরে রাখতে যথেষ্ট নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভোটাররা শুধু ভাতা নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সুশাসনের মতো বিষয়েই বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছেন। আর সেটাই আগামী দিনে বাংলার রাজনীতির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।