মস্কো: বৃহস্পতিবার মস্কোতে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের (Sergey Lavrov) সঙ্গে বৈঠকে বসেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর (S. Jaishankar)। বৈঠক শেষে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ভারতের উপর আরোপিত শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ উঠে আসে। এ প্রসঙ্গে জয়শঙ্কর স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমরা আসলেই খুব বিভ্রান্ত (perplexed) এই যুক্তি নিয়ে। কারণ আমরাই রাশিয়ান তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা নই, সেই জায়গায় রয়েছে চিন। আমরাই রাশিয়ান এলএনজি-র (LNG) সবচেয়ে বড় আমদানিকারক নই, সেটা ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সঙ্গে যে দেশের বাণিজ্য সবচেয়ে বেড়েছে, সেগুলিও ভারত নয়।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমেরিকাই গত কয়েক বছর ধরে বলেছে, বিশ্ব জ্বালানি বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে আমাদের তেল কিনতে হবে, এমনকি রাশিয়ার কাছ থেকেও। আমরা আমেরিকার কাছ থেকেও তেল কিনি এবং সেই পরিমাণও যথেষ্ট বেড়েছে। তাই যুক্তির ধারাবাহিকতায় সত্যিই একটা অসঙ্গতি রয়েছে।”
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভারত ব্যাপক হারে রাশিয়ান তেল আমদানি করেছে, যা মার্কিন প্রশাসনের অভিযোগের অন্যতম ভিত্তি। মার্কিন অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি দাবি করেন, ভারত শুধু রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় তেল কিনছে তাই নয়, সেই তেল প্রক্রিয়াকরণের পর পুনরায় বিক্রি করে মুনাফাও করছে। এই অভিযোগেই ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর আমেরিকা শুল্ক বসিয়েছে, যা ৫০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে একই পরিস্থিতিতে চিন কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কোনও সমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে জয়শঙ্কর আরও একবার স্মরণ করিয়ে দেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্ক বিশ্বের অন্যতম স্থিতিশীল সম্পর্ক। তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এখনও দৃঢ়। রাশিয়া ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যেখানে যৌথ উৎপাদন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মতো উদ্যোগ রয়েছে।”
বৈঠকের মূল আলোচনার অংশ ছিল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য। জয়শঙ্কর স্পষ্ট করেন যে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক শুধু জ্বালানি আমদানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। কৃষি, ওষুধ, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের রপ্তানি বৃদ্ধি করে বাণিজ্য ভারসাম্য ঠিক করার প্রয়াস চলছে। তাঁর বক্তব্য, “আমরা একমত হয়েছি যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আরও সুষম ও টেকসইভাবে বাড়ানো জরুরি।”
রাশিয়ান তেল আমদানিকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতকে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়তে হলেও, নয়া দিল্লির অবস্থান স্পষ্ট—এটি ভারতের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। একইসঙ্গে, ভারত জানিয়েছে যে তেলের প্রাপ্যতা, কম দাম এবং জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করেই এই আমদানি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সার্বিকভাবে বলতে গেলে, মস্কোতে ল্যাভরভ-জয়শঙ্কর বৈঠক শুধু দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ককেই নতুন মাত্রা দিল না, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের স্বাধীন অবস্থানকেও তুলে ধরল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও ভারত স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—নিজস্ব অর্থনৈতিক ও জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষাই তাদের প্রধান লক্ষ্য, এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেই তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।