ভূরাজনীতির জটিল সমীকরণের মধ্যেই আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে এক নতুন মোড়। রাশিয়া (Russia) ঘোষণা করেছে, ভারতকে অপরিশোধিত তেল বিক্রির ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে। মস্কোর এই সিদ্ধান্ত শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলাস্কায় আলোচনায় বসেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। সেই আলোচনায় শান্তি চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হলেও কোনও চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। তার পরেই ভারতকে পাঁচ শতাংশ বিশেষ ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে রাশিয়া।
ভারতের জন্য ‘স্ট্র্যাটেজিক’ ছাড়
রাশিয়ার এই ঘোষণায় ভারতকে শক্তিশালী বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। পুতিন এবং নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎ ও কূটনৈতিক তৎপরতা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের অন্যতম বড় ক্রেতা হিসেবে ভারত এখন বৈশ্বিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দুতে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (CREA)-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ভারতের মোট অপরিশোধিত তেল আমদানির প্রায় ৩৮ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। অথচ ২০২২ সালের আগে এই পরিমাণ ছিল মাত্র ১ শতাংশ।
স্পষ্টতই, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে ইউরোপীয় ক্রেতাদের কাছে রাশিয়ার দরজা বন্ধ হওয়ার পর ভারত এবং চীন রাশিয়ার জ্বালানি খাতকে টিকিয়ে রাখার মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছে। তবে প্রশ্ন উঠছে—এই ছাড় কি সরাসরি ভারতীয় সাধারণ মানুষের পকেটে স্বস্তি আনবে? বিশেষজ্ঞদের মতে, তা নয়। কারণ দেশে জ্বালানি তেলের চূড়ান্ত দাম নির্ধারণে সরকারের করনীতি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ছাড় পেলেও দেশীয় স্তরে ভোক্তারা তার সুফল পান না।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ভারত-রাশিয়া তেল বাণিজ্যের ইতিহাস নতুন নয়। ২০২১ সালে রসনেফট-এর সঙ্গে ভারতের একটি বড় চুক্তি হয়েছিল, যেখানে ২০ লাখ টন অপরিশোধিত তেল আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের জ্বালানি সম্পর্ক ছিল তুলনামূলকভাবে সীমিত। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জেরে পরিস্থিতি বদলে যায়। রাশিয়া তখন এশীয় বাজারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে শুরু করে। ভারতও সেই সুযোগ গ্রহণ করে।
ফলে গত তিন বছরে রাশিয়া ভারতের জন্য অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী হিসেবে উঠে এসেছে। বিশেষত ‘ডিসকাউন্টেড অয়েল’ বা ছাড়ে তেল পাওয়ার কৌশল ভারতীয় রিফাইনারিগুলির কাছে লাভজনক হয়ে উঠেছে।
মার্কিন চাপে ভারতের অবস্থান
কিন্তু এর মধ্যেই নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনার সময় ওয়াশিংটন স্পষ্ট জানায়, ভারতের এই পদক্ষেপ আসলে রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সাহায্য করছে। মার্কিন প্রশাসনের বক্তব্য, ছাড়ে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কিনে ভারত পরোক্ষভাবে রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রকে জ্বালানি যোগাচ্ছে।
ভারত অবশ্য বারবারই দাবি করেছে, তার অবস্থান নিরপেক্ষ। নয়াদিল্লির বক্তব্য, দেশের শক্তি নিরাপত্তাই সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারী দেশ হিসেবে ভারত সুলভ ও স্থিতিশীল জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে চাইছে। আন্তর্জাতিক সংঘাতের কারণে দেশের শিল্প, কৃষি ও পরিবহণ খাত যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটাই সরকারের লক্ষ্য।
বৈশ্বিক শক্তির সমীকরণে নতুন দিক
রাশিয়ার এই বিশেষ ছাড় ঘোষণার ফলে বৈশ্বিক শক্তি-রাজনীতির সমীকরণে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। একদিকে আমেরিকা ও ইউরোপ চাপ বাড়াচ্ছে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে, অন্যদিকে ভারত ও চীন বড় ক্রেতা হিসেবে রাশিয়ার অর্থনীতিকে অক্সিজেন দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতি আগামী দিনে জ্বালানি বাজারের গতিপথকে অনেকটাই প্রভাবিত করবে।
বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি ও ভূরাজনৈতিক সংঘাতের মধ্যে ভারতের এই কৌশল একদিকে স্বল্পমেয়াদে অর্থনৈতিক সুবিধা দিলেও দীর্ঘমেয়াদে আন্তর্জাতিক কূটনীতির জটিলতা বাড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার ভারসাম্য রক্ষা করা আগামী দিনে ভারতের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে।
রাশিয়ার দেওয়া এই বিশেষ ছাড় নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য অর্থনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তবে দেশীয় ভোক্তাদের প্রত্যাশিত স্বস্তি কতটা মিলবে, তা নির্ভর করবে কেন্দ্রের করনীতি ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর। একই সঙ্গে, এই ছাড় ভারতের নিরপেক্ষ কূটনীতির পরীক্ষাও বটে। এখন দেখার, বিশ্বের দুই শক্তিধর ব্লকের টানাপোড়েনের মধ্যে ভারত কীভাবে নিজের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।