বাংলায় ওবিসি (OBC Certificate) সার্টিফিকেটের অপব্যবহার নিয়ে নয়া বিতর্ক। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের নেতাদের বিরুদ্ধে ভুয়ো ওবিসি শংসাপত্র দাখিল করে সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনার কেন্দ্রে রয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার চণ্ডীপুর ব্লকের ঈশ্বরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান শ্রীমতী খুকুরানি মণ্ডল ঘোড়াই।
অভিযোগ, তিনি ভুয়ো ওবিসি শংসাপত্র জমা দিয়ে ওবিসি সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই ঘটনার পর তিনি কেবল পঞ্চায়েত প্রধানের পদই নয়, পঞ্চায়েত সদস্যের পদও হারাতে চলেছেন।বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এই ঘটনাকে ‘হিমশৈলের চূড়া’ বলে উল্লেখ করেছেন।
তিনি দাবি করেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রশাসন ওবিসি সার্টিফিকেটকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা প্রশাসনের সহায়তায় ভুয়ো শংসাপত্রের মাধ্যমে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। সঠিক তদন্ত হলে রাজ্যজুড়ে এমন হাজার হাজার ঘটনা প্রকাশ্যে আসবে।”
তিনি আরও অভিযোগ করেছেন যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে তোষণ করার জন্য ওবিসি সার্টিফিকেটের অপব্যবহার করছেন, যাতে তাঁরা সরকারি চাকরি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে সুবিধা পান।
এই বিতর্ক রাজ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ২০২৪ সালের মে মাসে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার বেঞ্চ রাজ্যের প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করে দেয়। আদালতের নির্দেশ ছিল, ২০১০ সালের পরে জারি করা সমস্ত ওবিসি শংসাপত্র অবৈধ এবং এগুলো ভবিষ্যতে কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না।
এই রায়ের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সরকারি কলেজগুলিতে ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়ায় প্রায় ৫ লক্ষ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ করেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি এবং তোষণ নীতির কারণে রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বিপন্ন।” তিনি আরও দাবি করেছেন যে, মুখ্যমন্ত্রী নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে সুবিধা দেওয়ার জন্য ওবিসি সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করছেন।
এই অভিযোগের পাল্টা জবাবে তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে বলা হয়েছে, ওবিসি তালিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এবং আদালতের নির্দেশ মেনে চলছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভায় বলেছেন, “ওবিসি শংসাপত্র প্রদানে কোনো ধর্মের প্রভাব নেই। এটি সম্পূর্ণরূপে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।”
তিনি আরও জানিয়েছেন, রাজ্যে বর্তমানে ৪৯টি ওবিসি ‘এ’ এবং ৯১টি ওবিসি ‘বি’ শ্রেণি রয়েছে, এবং আরও ৫০টি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সমীক্ষা চলছে।
এই বিতর্কের মধ্যে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করেছে। চলতি বছরের মার্চে সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময় রাজ্যের তরফে আইনজীবী কপিল সিব্বল জানিয়েছিলেন, নতুন করে ওবিসি তালিকা প্রস্তুতির জন্য সমীক্ষা শুরু হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট জুলাই মাসে পরবর্তী শুনানির জন্য সময় দিয়েছে। সম্প্রতি, সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশের উপর স্থগিতাদেশ জারি করেছে, যা এই মামলার জটিলতাকে আরও বাড়িয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই বিতর্ক আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনাকে ‘বিরোধীদের অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিলেও, বিজেপি এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে, এই ঘটনা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সংরক্ষণ নীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
বকেয়া কর না দেওয়ায় দিঘায় হোটেল বন্ধের চাঞ্চল্য, আজ বৈঠক
শিক্ষার্থীদের একাংশকে বাধ্য হয়ে রাজ্যের বাইরে বা বেসরকারি কলেজে উচ্চ খরচে পড়াশোনা করতে হচ্ছে।এই ঘটনা রাজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতাকে আরও উজ্জ্বল করেছে। ওবিসি সংরক্ষণের মূল লক্ষ্য ছিল অনগ্রসর সম্প্রদায়ের উন্নয়ন, কিন্তু এই অভিযোগগুলো সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আগামী দিনে সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ এই বিতর্কের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে।