বুধবার ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন যে জটিল ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ভারত ও রাশিয়ার (India-Russia Ties) উচিত সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করা। তিনি এই মন্তব্য করেন মস্কোতে রাশিয়ার প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ডেনিস মান্তুরভের সঙ্গে এক বৈঠকে। এই বৈঠকটি ভারত-রাশিয়া আন্তঃসরকারি কমিশন ফর ট্রেড, ইকোনমিক, সায়েন্টিফিক, টেকনোলজিকাল অ্যান্ড কালচারাল কো-অপারেশন (IRIGC-TEC)-এর কাঠামোর অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। এই সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল চলতি বছরের শেষে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
জয়শঙ্কর তাঁর টেলিভিশন সম্প্রচারিত উদ্বোধনী বক্তৃতায় বলেন, ভারত ও রাশিয়ার উচিত তাদের সহযোগিতার এজেন্ডা ক্রমাগত বৈচিত্র্যময় ও প্রসারিত করা, যার মধ্যে রয়েছে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং আরও যৌথ উদ্যোগ গড়ে তোলা। তিনি বলেন, “আরও করা এব ং ভিন্নভাবে করা আমাদের মন্ত্র হওয়া উচিত।” এই মন্তব্য এসেছে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে, যখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের উপর শুল্ক ৫০ শতাংশে দ্বিগুণ করেছেন, যার মধ্যে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ক্রয়ের জন্য অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে।
জয়শঙ্করের মস্কো সফর এবং ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক
জয়শঙ্কর ১৯ আগস্ট মঙ্গলবার তিন দিনের সফরে মস্কোতে পৌঁছান। তিনি IRIGC-TEC-এর ২৬তম অধিবে শনের সহ-সভাপতিত্ব করেন এবং ভারত-রাশিয়া বিজনেস ফোরামে বক্তৃতা দেন। তিনি রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেন, যেখানে দুই দেশের সম্পর্ক, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক বিষয়ে মতবিনিময় হয়। এই সফর ভারত-রাশিয়ার বিশেষ ও বিশিষ্ট কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে জয়শঙ্কর বলেন, “বিভিন্ন কার্যকরী গোষ্ঠী এবং উপ-গোষ্ঠীগুলির উচিত তাদের নিজ নিজ এজেন্ডার প্রতি আরও সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতি গ্রহণ করা। আমরা যে বৃহত্তর পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছি, তার চ্যালেঞ্জগুলি আমাদের এইভাবে কাজ করতে বাধ্য করে।” তিনি আরও বলেন, পারস্পরিক পরামর্ শের মাধ্যমে দুই পক্ষের উচিত তাদের এজেন্ডা ক্রমাগত বৈচিত্র্যময় ও প্রসারিত করা। “এটি আমাদের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সম্পর্কের পূর্ণ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সাহায্য করবে। আমাদের পুরানো পথে আটকে থাকা উচিত নয়।”
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা
জয়শঙ্কর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক প্রসারিত করতে “পরিমাণগত লক্ষ্য এবং নির্দিষ্ট সময়সীমা” নির্ধারণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “আমি প্রস্তাব করছি যে আমরা নিজেদের জন্য কিছু পরিমাণগত লক্ষ্য এবং নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করি, যাতে আমরা নিজেদের আরও বেশি অর্জনের জন্য চ্যালেঞ্জ করতে পারি।” তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, “যদি আমরা বাণিজ্য বাধাগুলির দিকে তাকাই, তবে আমরা কি নির্দিষ্ট সংখ্যক বাধা বাছাই করে তা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিতে পারি? যদি আমরা কোনো প্রস্তাবে সম্মত হই, তবে কি আমরা এর জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারি?”
তিনি ভারত-রাশিয়া বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা দূর করার এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বৈচিত্র্য বৃদ্ধির জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। ২০২১ সাল থেকে দুই দেশের বাণিজ্য প াঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে বাণিজ্য ঘাটতি নয় গুণ বেড়েছে। তিনি ভারত-ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা দ্রুত শেষ করার আহ্বান জানান। এছাড়াও, তিনি বিজনেস ফোরাম এবং IRIGC-এর কার্যকরী গোষ্ঠীর মধ্যে একটি সমন্বয় ব্যবস্থা তৈরির প্রস্তাব দেন, যাতে ধারণার দ্বিমুখী প্রবাহ নিশ্চিত হয়।
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট
পশ্চিমবঙ্গের জন্য ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের এই গতিশীলতা অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষি পণ্য, যেমন চা, পাট এবং মৎস্য পণ্য, রাশিয়ার বাজারে রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে। জয়শঙ্করের প্রস্তাবিত যৌথ উদ্যোগ এবং বাণিজ্য বৈচিত্র্যের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে অংশ নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের চা শিল্প, যা ভারতের মোট চা রপ্তানির প্রায় ২৫% অবদান রাখে, রাশিয়ার বাজারে প্রবেশের জন্য নতুন সুযোগ পেতে পারে। তবে, মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির কারণে ভারতীয় রপ্তানিতে প্রভাব পড়লে পশ্চিমবঙ্গের কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের গুরুত্ব বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, বিশেষ করে রাশিয়ার তেল ক্রয়ের কারণে, ভারতকে তার কৌশলগত অংশীদারিত্ব বৈ চিত্র্যময় করতে বাধ্য করেছে। ২০২৪-২৫ সালে ভারতের তেল আমদানির ৩৫.১ শতাংশ রাশিয়া থেকে এসেছে, যা রাশিয়াকে ভারতের বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী করেছে। এই প্রেক্ষাপটে, জয়শঙ্করের মস্কো সফর ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এস জয়শঙ্করের “আরও করা, ভিন্নভাবে করা” মন্ত্র ভারত-রাশিয়া সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেওয়ার লক্ষ্যে একটি কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি। বাণিজ্য বৈচিত্র্য, যৌথ উদ্যোগ এবং পরিমাণগত লক্ষ্য নির্ধারণের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের জন্য, এই সম্পর্ক রপ্তানি এবং বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। তবে, মার্কিন শুল্কের প্রভাব মোকাবেলায় কৌশলগত পরিকল্পনা প্রয়োজন। ভারত ও রাশিয়ার এই কৌশলগত অংশীদারিত্ব ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও শক্তিশালী থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে।