বাজারের অস্থিরতা ব্যাখ্যা! পেঁয়াজ ও আলুর দাম কেন এত ওঠানামা করে?

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতিতে পেঁয়াজ এবং আলু দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। এই ফসলগুলি শুধুমাত্র গ্রামীণ কৃষকদের জীবিকার উৎসই নয়, বরং ভারতীয় রান্নাঘরের অপরিহার্য উপাদান। তবে, পেঁয়াজ এবং…

Why Potato and Onion Prices Fluctuate: Understanding Market Volatility and Its Impact on Farmers in West Bengal

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতিতে পেঁয়াজ এবং আলু দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফসল। এই ফসলগুলি শুধুমাত্র গ্রামীণ কৃষকদের জীবিকার উৎসই নয়, বরং ভারতীয় রান্নাঘরের অপরিহার্য উপাদান। তবে, পেঁয়াজ এবং আলুর দামের (Potato and Onion Price) তীব্র ওঠানামা কৃষক, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাজারের অস্থিরতা কৃষকদের আয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করে এবং ভোক্তাদের জন্য খাদ্যের বাজেটে চাপ সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় সরকারের টপ (টমেটো, পেঁয়াজ, আলু) স্কিম এই অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও সমস্যা এখনও অমীমাংসিত। এই নিবন্ধে আমরা পেঁয়াজ এবং আলুর দামের অস্থিরতার কারণ, এর প্রভাব এবং সমাধানের সম্ভাব্য উপায় নিয়ে আলোচনা করব।

Also Read | কীভাবে নকল কৃষি রাসায়নিক ফসল ধ্বংস এবং কৃষকদের জীবিকার ক্ষতি করছে

   

দামের অস্থিরতার কারণ
পেঁয়াজ এবং আলুর দামের ওঠানামার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে:

  • মৌসুমী উৎপাদন: পেঁয়াজ এবং আলু মৌসুমী ফসল। পশ্চিমবঙ্গে পেঁয়াজের প্রধান ফসল (রবি) এপ্রিল-মে মাসে কাটা হয়, এবং আলুর ক্ষেত্রে এটি নভেম্বর-জানুয়ারি। এই সময়ে বাজারে প্রচুর সরবরাহ থাকায় দাম কমে যায়। বিপরীতে, অফ-সিজনে সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে পেঁয়াজের দাম সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে বেড়ে গিয়েছিল কারণ রবি ফসলের মজুদ কমে গিয়েছিল।
  • আবহাওয়ার প্রভাব: অতিরিক্ত বৃষ্টি, খরা, বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ফসলের উৎপাদন ব্যাহত করে। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে অতিবৃষ্টির কারণে পেঁয়াজের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে দাম ১০০ টাকা প্রতি কেজি ছাড়িয়ে যায়। এই ধরনের আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা দামের অস্থিরতার একটি প্রধান কারণ।
  • অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও বাজারের গতিশীলতা: পশ্চিমবঙ্গে পেঁয়াজ এবং আলুর উৎপাদন প্রধানত বর্ধমান, হুগলি, এবং মেদিনীপুরের মতো জেলাগুলিতে কেন্দ্রীভূত। এই অঞ্চলগুলিতে উৎপাদন বা সরবরাহে কোনো সমস্যা হলে রাজ্যের অন্যান্য বাজারে দামের উপর প্রভাব পড়ে। এছাড়াও, মধ্যস্থিতকারীদের বাজারে আধিপত্য এবং অ্যান্টি-কম্পিটিটিভ ট্রেড প্র্যাকটিস দামের অস্থিরতা বাড়ায়।
  • রপ্তানি নীতি: ভারত পেঁয়াজের একটি প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বা ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য (এমইপি) নির্ধারণের মতো সরকারি নীতি দেশীয় বাজারে সরবরাহ এবং দামের উপর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, যা দেশীয় বাজারে দাম কমিয়েছিল কিন্তু কৃষকদের ক্ষতির মুখে ফেলেছিল।
  • মজুদ ও সরবরাহ শৃঙ্খলের সমস্যা: পেঁয়াজ এবং আলুর পচনশীল প্রকৃতির কারণে আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ সুবিধার অভাবে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়। পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধার অভাবে কৃষকরা ফসল মজুদ করতে পারেন না, যা বাজারে সরবরাহের অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

কৃষকদের উপর প্রভাব
দামের অস্থিরতা কৃষকদের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করে। যখন দাম অত্যন্ত কমে যায়, তখন কৃষকরা উৎপাদন খরচ তুলতে পারেন না। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের লাসালগাঁও বাজারে পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ১ টাকায় নেমে গিয়েছিল, যা উৎপাদন খরচের (৯-১০ টাকা/কেজি) তুলনায় অনেক কম ছিল। এর ফলে অনেক কৃষক ফসল ফেলে দিতে বাধ্য হন। বিপরীতে, যখন দাম বেড়ে যায়, তখন মধ্যস্থিতকারী এবং ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করেন, কিন্তু কৃষকদের অংশ সীমিত থাকে। এই অস্থিরতা কৃষকদের উৎপাদন এবং বিনিয়োগের সিদ্ধান্তকে ব্যাহত করে, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদে কৃষি খাতে অদক্ষতা দেখা দেয়।

Also Read | অবিরাম বৃষ্টিতে দেশে কমছে সয়াবিন চাষের ক্ষেত্রফল

Advertisements

টপ স্কিম ও সরকারি হস্তক্ষেপ
কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অপারেশন গ্রিনস’ বা টপ স্কিম পেঁয়াজ, আলু এবং টমেটোর দামের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের জন্য চালু করা হয়েছে। এই স্কিমের অধীনে পরিবহন ও স্টোরেজের জন্য ৫০% ভর্তুকি প্রদান করা হয়, যাতে অতিরিক্ত সরবরাহের সময় ফসল নষ্ট না হয় এবং দাম স্থিতিশীল থাকে। এছাড়াও, মার্কেট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (এমআইইডব্লিউএস) পোর্টালের মাধ্যমে সরকার টপ ফসলের দাম এবং সরবরাহ নিরীক্ষণ করে। এই পোর্টাল বাজারে সম্ভাব্য বিঘ্নের বিষয়ে সতর্ক করে এবং সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করে।

তবে, এই স্কিমের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বা ন্যূনতম রপ্তানি মূল্য নির্ধারণের মতো ব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে দাম কমাতে সফল হয় না। এছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গে পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ এবং দক্ষ সরবরাহ শৃঙ্খলের অভাবে টপ স্কিমের পূর্ণ সুবিধা পাওয়া যায় না।

সমাধানের উপায়
দামের অস্থিরতা মোকাবিলায় নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

  1. উন্নত স্টোরেজ সুবিধা: পশ্চিমবঙ্গে আরও কোল্ড স্টোরেজ এবং গুদাম নির্মাণ করা প্রয়োজন, যাতে পচনশীল ফসল মজুদ করা যায় এবং সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
  2. বাজার গোয়েন্দা ব্যবস্থা: অ্যান্টি-কম্পিটিটিভ ট্রেড প্র্যাকটিস নিরীক্ষণের জন্য শক্তিশালী বাজার গোয়েন্দা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
  3. ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি): পেঁয়াজ এবং আলুর জন্য ন্যূনতম সমর্থন মূল্য নির্ধারণ করলে কৃষকরা কম দামের সময় ক্ষতির মুখে পড়বেন না। গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে পেঁয়াজের জন্য প্রতি কুইন্টাল ৩৫০ টাকা এমএসপি যুক্তিসঙ্গত হতে পারে।
  4. যান্ত্রিকীকরণ ও প্রযুক্তি: উন্নত চাষ পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার ফলন বাড়াতে এবং উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করবে।
  5. রপ্তানি নীতির সংস্কার: রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পরিবর্তে আরও সুষ্ঠু নীতি গ্রহণ করা উচিত, যাতে কৃষক এবং ভোক্তা উভয়ই উপকৃত হন।

পেঁয়াজ এবং আলুর দামের অস্থিরতা পশ্চিমবঙ্গের কৃষক এবং ভোক্তাদের জন্য একটি জটিল সমস্যা। মৌসুমী উৎপাদন, আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা, বাজারের গতিশীলতা এবং অপর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা এই অস্থিরতার প্রধান কারণ। টপ স্কিম এবং অন্যান্য সরকারি হস্তক্ষেপ এই সমস্যা কিছুটা সমাধান করলেও আরও সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। উন্নত স্টোরেজ, বাজার গোয়েন্দা ব্যবস্থা এবং ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের মাধ্যমে কৃষকদের জন্য ন্যায্য আয় এবং ভোক্তাদের জন্য স্থিতিশীল দাম নিশ্চিত করা সম্ভব। এই সমস্যার সমাধান না হলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাত এবং খাদ্য নিরাপত্তা ভবিষ্যতে আরও বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।