কীভাবে নকল কৃষি রাসায়নিক ফসল ধ্বংস এবং কৃষকদের জীবিকার ক্ষতি করছে

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো এর কৃষক সম্প্রদায়, যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাজারের ওঠানামার মতো নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে ফসল উৎপাদন করে। কিন্তু…

Bengal Farmers Embrace Cow Urine-Based Bio-Pesticides to Slash Costs and Boost Sustainable Farming

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো এর কৃষক সম্প্রদায়, যারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং বাজারের ওঠানামার মতো নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে ফসল উৎপাদন করে। কিন্তু বর্তমানে আরেকটি নতুন এবং ভয়াবহ হুমকি এই সম্প্রদায়ের জন্য বিপদ ডেকে আনছে—জাল কীটনাশক (Fake Pesticides)। ভারতে জাল কীটনাশক শিল্প বছরে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এটি বর্তমানে মোট কৃষি সুরক্ষা বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ দখল করে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যে, যেখানে ধান, আলু, পাট এবং শাকসবজির মতো ফসলের উপর কৃষকরা নির্ভরশীল, জাল কীটনাশকের ব্যবহার ফসলের ক্ষতি, আর্থিক ক্ষতি এবং পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা জাল কীটনাশকের উত্থান, এর কৃষকদের জীবিকা এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতের উপর প্রভাব এবং এই সমস্যা মোকাবিলায় কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করব।

জাল কীটনাশকের উত্থান
ভারতের কৃষি রাসায়নিক শিল্প বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম কীটনাশক উৎপাদক এবং ষষ্ঠ বৃহত্তম রপ্তানিকারক। তবে, এই শিল্পের সমান্তরালে একটি অবৈধ বাজার বিকশিত হয়েছে, যেখানে জাল কীটনাশক বিক্রি হচ্ছে। এই জাল পণ্যগুলো প্রায়শই আসল পণ্যের মতো প্যাকেজিংয়ে বিক্রি হয়, যা কৃষকদের জন্য আসল এবং নকল পণ্যের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে বর্ধমান, হুগলি, এবং নদিয়ার মতো কৃষিপ্রধান জেলাগুলিতে, কৃষকরা প্রায়শই স্থানীয় বিক্রেতাদের উপর নির্ভর করে কীটনাশক ক্রয় করেন। এই বিক্রেতারা কখনো কখনো উচ্চ মুনাফার লোভে নকল পণ্য বিক্রি করেন, যা কৃষকদের অজান্তেই ব্যবহার করা হয়।

   

একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারতে প্রতি বছর প্রায় ১০.৬ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য জাল কীটনাশকের কারণে নষ্ট হয়। পশ্চিমবঙ্গে, ধান এবং আলুর মতো ফসলগুলি কীটপতঙ্গ এবং রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং জাল কীটনাশকের ব্যবহার এই ক্ষতিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫-১৬ সালে পাঞ্জাবে সুতির ফসলের ৫ লক্ষ হেক্টরের বেশি জাল কীটনাশকের কারণে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গেও এ ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক নয়, যেখানে কৃষকরা ফসলের ক্ষতি এবং আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হন।

কৃষকদের জীবিকার উপর প্রভাব
জাল কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকদের জন্য একাধিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত, এই পণ্যগুলি কীটপতঙ্গ বা রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, যার ফলে ফসলের উৎপাদন কমে যায়। দ্বিতীয়ত, এই জাল পণ্যগুলিতে বিষাক্ত এবং অপরীক্ষিত রাসায়নিক থাকতে পারে, যা মাটির উর্বরতা নষ্ট করে এবং ভূগর্ভস্থ জল দূষিত করে। তৃতীয়ত, জাল কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকদের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, যেমন চোখের জ্বালা, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট এবং ত্বকের সমস্যা। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে কৃষকদের মধ্যে শিক্ষার হার এবং সচেতনতা কম, তারা প্রায়শই এই জাল পণ্যের শিকার হন।

একটি উদাহরণ হিসেবে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার একজন কৃষক, হরবংশ সিং, বলেন, “আমরা অশিক্ষিত কৃষক; আমরা বিক্রেতার পরামর্শের উপর নির্ভর করি এবং ফসলে স্প্রে করি। কিন্তু যখন ফসল শুকিয়ে যায় এবং আমাদের টাকা নষ্ট হয়, তখন বুঝতে পারি যে আমরা জাল কীটনাশক কিনেছি।” এই ধরনের ঘটনা কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, এবং কিছু ক্ষেত্রে এটি কৃষকদের আত্মহত্যার মতো চরম পদক্ষেপের দিকে ঠেলে দেয়।

কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের মধ্যে জাল কীটনাশক সম্পর্কে সচেতনতার অভাব একটি বড় সমস্যা। অনেক কৃষক শিক্ষার অভাবে এবং স্থানীয় বিক্রেতাদের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার কারণে জাল পণ্য ক্রয় করেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, কৃষকরা প্রায়শই পণ্যের প্যাকেজিংয়ের উপর ভিত্তি করে কীটনাশক ক্রয় করেন, এবং আইএসআই বা এজিমার্ক চিহ্নের উপর নির্ভর করেন। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে, অসাধু ব্যবসায়ীরা জাল আইএসআই/এজিমার্ক চিহ্নযুক্ত পণ্য তৈরি করছে, যা কৃষকদের প্রতারিত করছে।

Advertisements

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সৌদি আরবে ৭৩.৫% কৃষক গত তিন বছরে জাল কীটনাশক ক্রয় করেছেন, এবং ৯৮.৫% ক্ষেত্রে তারা এই পণ্যগুলিকে আসল বলে মনে করেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও অনুরূপ পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, যেখানে কৃষকরা ফসলের ক্ষতি হওয়ার পরে জাল পণ্যের বিষয়ে জানতে পারেন। এই সমস্যা মোকাবিলায় কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি।

সমাধানের পথ
জাল কীটনাশকের সমস্যা মোকাবিলায় সরকার, কৃষি সম্প্রসারণ পরিষেবা এবং বেসরকারি সংস্থাগুলির সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে, কৃষি বিভাগের উচিত নিয়মিত কৃষক সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করা, যেখানে কৃষকদের জাল কীটনাশক শনাক্ত করার উপায় সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হবে। উদাহরণস্বরূপ, ক্রপলাইফ ইন্ডিয়া গত তিন বছর ধরে ২ লক্ষ কীটনাশক বিক্রেতাদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে জাল পণ্যের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করেছে। এছাড়াও, তারা একটি অনলাইন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে, যা বিক্রেতাদের জাল পণ্য শনাক্ত করতে সহায়তা করে।

পশ্চিমবঙ্গে কৃষকদের জন্য অনুরূপ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। এছাড়াও, বারকোড এবং ট্র্যাক-এন্ড-ট্রেস প্রযুক্তির মতো অ্যান্টি-কাউন্টারফিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাল পণ্যের প্রবেশ রোধ করা সম্ভব। কৃষকদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে, তাই ব্যবহারকারী-বান্ধব অ্যাপের মাধ্যমে পণ্যের সত্যতা যাচাই করার সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে।

জাল কীটনাশক পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি। এই নকল পণ্যগুলি ফসলের ক্ষতি, কৃষকদের আর্থিক সংকট এবং পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কৃষি সংস্থাগুলির উচিত এই সমস্যার বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে কৃষকরা তাদের ফসল এবং জীবিকা রক্ষা করতে পারেন।