কেন্দ্রীয় সরকার জনকল্যাণমূলক সুবিধার অপব্যবহার রোধে একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (পিডিএস)-এর অধীনে ১ কোটির বেশি অযোগ্য রেশন কার্ডধারীকে (Ineligible Ration Card) চিহ্নিত করে তাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সমস্ত রাজ্য সরকারকে। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন (এনএফএসএ)-এর অধীনে বিনামূল্যে রেশন নেওয়া অনেক সুবিধাভোগী উচ্চ আয়, করদাতা হওয়া বা চার চাকার গাড়ির মালিকানার কারণে এই সুবিধার জন্য যোগ্য নন বলে জানা গেছে। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য হলো শুধুমাত্র প্রকৃত প্রয়োজনীয় ব্যক্তিরা এনএফএসএ-র সুবিধা পান তা নিশ্চিত করা। ১৯ আগস্ট, ২০২৫ পর্যন্ত, ভারত জুড়ে ১৯.১৭ কোটি রেশন কার্ড জারি করা হয়েছে, যা ৭৬.১০ কোটি সুবিধাভোগীকে কভার করে।
কেন্দ্রের কঠোর পদক্ষেপ
কেন্দ্রীয় খাদ্য ও জনবণ্টন বিভাগ রেশন কার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (আরসিএমএস) ডেটার সঙ্গে আয়কর বিভাগ, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রণালয়ের ডেটাবেসের তথ্য মিলিয়ে একটি ব্যাপক ক্রস-ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া চালিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে যে প্রায় ১.১৭ কোটি রেশন কার্ডধারী এনএফএসএ-র অধীনে বিনামূল্যে খাদ্যশস্য পাওয়ার জন্য যোগ্য নন। এর মধ্যে ৯৪.৭১ লক্ষ করদাতা, ১৭.৫১ লক্ষ চার চাকার গাড়ির মালিক এবং ৫.৩১ লক্ষ কোম্পানির পরিচালক রয়েছেন।
কেন্দ্রীয় খাদ্য সচিব সঞ্জীব চোপড়া ৮ জুলাই, ২০২৫ তারিখে রাজ্যের মুখ্য সচিবদের কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে জানিয়েছেন যে, ডুপ্লিকেট, মৃত বা নিষ্ক্রিয় রেশন কার্ডধারীদের তথ্য সংশোধনের জন্য ফিল্ড ভেরিফিকেশন করতে হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, রাজ্যগুলির দায়িত্ব হলো তাদের ডেটাবেস পরিষ্কার করা এবং এর ফলে যোগ্য কিন্তু বাদ পড়ে যাওয়া পরিবারগুলিকে তালিকায় যুক্ত করা সম্ভব হবে। এই প্রক্রিয়াটি ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এর মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কে অযোগ্য পিডিএস-এর জন্য?
জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন, ২০১৩-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, নিম্নলিখিত ব্যক্তি বা পরিবারগুলি পিডিএস-এর অধীনে বিনামূল্যে বা ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য পাওয়ার জন্য যোগ্য নয়:
- রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী
- বার্ষিক আয় ১ লক্ষ টাকা বা তার বেশি হওয়া পরিবার
- চার চাকার গাড়ির মালিক
- আয়করদাতা
- কোম্পানির পরিচালক
এই শ্রেণিগুলিকে অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তাই তাদের নিম্ন-আয়ের গোষ্ঠীর জন্য লক্ষ্যযুক্ত জনকল্যাণ সুবিধা থেকে বাদ দেওয়া হয়। সরকারের উদ্দেশ্য হলো এই প্রকল্পটি শুধুমাত্র প্রকৃত অভাবীদের কাছে পৌঁছায়।
ডিজিটাইজেশনের ভূমিকা
পিডিএস সিস্টেমে স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা বাড়াতে ডিজিটাইজেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, প্রায় ৫.৮ কোটি জাল রেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে, যা আধার-ভিত্তিক প্রমাণীকরণ এবং ইলেকট্রনিক নো ইউর কাস্টমার (ই-কেওয়াইসি) যাচাইয়ের মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে, ২০.৪ কোটি রেশন কার্ডের মধ্যে ৯৯.৮% আধারের সঙ্গে সংযুক্ত এবং ৯৮.৭% সুবিধাভোগীর বায়োমেট্রিক প্রমাণীকরণ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও, দেশব্যাপী ৫.৩৩ লক্ষ ফেয়ার প্রাইস শপে ই-পিওএস ডিভাইস স্থাপন করা হয়েছে, যা আধার-ভিত্তিক প্রমাণীকরণের মাধ্যমে সঠিক সুবিধাভোগীদের খাদ্যশস্য বিতরণ নিশ্চিত করে।
এই ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া খাদ্যশস্য বিতরণে ফাঁস কমিয়েছে এবং অযোগ্য সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে সিস্টেমকে আরও কার্যকর করেছে। ‘ওয়ান নেশন ওয়ান রেশন কার্ড’ স্কিমের মাধ্যমে সুবিধাভোগীরা দেশের যেকোনো ফেয়ার প্রাইস শপ থেকে তাদের রেশন গ্রহণ করতে পারেন, যা পিডিএস-এর পোর্টেবিলিটি বাড়িয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে পিডিএস সংস্কার
উত্তরপ্রদেশে পিডিএস-এর স্বচ্ছতা বাড়াতে রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০২১ সালে, রাজ্যে প্রায় ৩.২ কোটি রেশন কার্ডধারী এবং ৪০ লক্ষের বেশি অন্ত্যোদয় স্কিমের সুবিধাভোগীর তথ্য ডিজিটাইজ করা হয়েছে। ই-পিওএস মেশিনের মাধ্যমে ১১,০০০ শহুরে এবং ৬৮,৮৫০ গ্রামীণ ফেয়ার প্রাইস শপে খাদ্যশস্য বিতরণ পরিচালিত হচ্ছে। আধার যাচাই এবং ওটিপি সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করা হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, প্রায় ৩.৩ কোটি লেনদেন আধার যাচাইয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমালোচনা
যদিও ডিজিটাইজেশন এবং ক্রস-ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া পিডিএস-এর দক্ষতা বাড়িয়েছে, তবে এটি কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। বিশেষ করে, বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে আধার-ভিত্তিক প্রমাণীকরণ এবং ই-কেওয়াইসি প্রক্রিয়ার কারণে অনেক যোগ্য সুবিধাভোগী বাদ পড়েছেন। ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা এবং বিহারের মতো রাজ্যে মুশাহার সম্প্রদায়ের মতো প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলি ডকুমেন্টেশন এবং ডিজিটাল বাধার কারণে রেশন কার্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এছাড়াও, ফেয়ার প্রাইস শপগুলিতে কম পরিমাণে বা নিম্নমানের খাদ্যশস্য বিতরণের অভিযোগ উঠেছে।
কৃষক সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য পিডিএস একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এই সিস্টেমের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যশস্য পাওয়া গ্রামীণ পরিবারগুলির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, অযোগ্য সুবিধাভোগীদের বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যোগ্য কৃষক পরিবারগুলি যাতে বাদ না পড়ে, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। কৃষক সম্প্রদায়ের অনেকে নিম্ন-আয়ের গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, এবং তাদের জন্য পিডিএস একটি জীবনরেখা। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে ফিল্ড ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ এবং ন্যায্য হয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপ পিডিএস-এর স্বচ্ছতা এবং দক্ষতা বাড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ১.১৭ কোটি অযোগ্য রেশন কার্ডধারীকে বাদ দিয়ে সরকার যোগ্য পরিবারগুলির জন্য স্থান তৈরি করছে। তবে, এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলির বাদ পড়ার ঝুঁকি এড়াতে ফিল্ড ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে। ডিজিটাইজেশন এবং আধার-ভিত্তিক প্রমাণীকরণ পিডিএস-কে আরও কার্যকর করলেও, যোগ্য সুবিধাভোগীদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা অত্যন্ত জরুরি। ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এর মধ্যে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে, পিডিএস আরও শক্তিশালী এবং লক্ষ্যভিত্তিক হবে।