ভারতে এ বছর সয়াবিন চাষের (Soybean Cultivation) ক্ষেত্রফল উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা প্রধানত অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং কৃষকদের অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে ঘটেছে। সয়াবিন প্রসেসর অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (এসওপিএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে সয়াবিন চাষের ক্ষেত্রফল গত বছরের তুলনায় ৩.১১ লাখ হেক্টর বা ২.৬৩ শতাংশ কমেছে।
এই হ্রাসের পিছনে দুটি প্রধান কারণ হলো বপনের সময় অবিরাম বৃষ্টি এবং কৃষকদের সয়াবিনের পরিবর্তে অন্য ফসল, যেমন ডালজাতীয় ফসল বা তুলা, চাষের দিকে ঝোঁক। এই পরিস্থিতি ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ সয়াবিন দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তৈলবীজ ফসল।
এসওপিএ-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে সয়াবিন ফসলের অবস্থা সাধারণত স্বাভাবিক এবং প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে ফসল ফুলের পর্যায়ে রয়েছে। তবে, মহারাষ্ট্রের ওয়াশিম, অকোলা, হিঙ্গোলি এবং আমরাভাতির কিছু অংশে বিলম্বিত বপন বা পুনঃবপনের কারণে গাছের উচ্চতা কম এবং বৃদ্ধি ধীর হয়েছে।
রাজস্থানেও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা এবং বপনের বিলম্ব দেখা গেছে, যা ফসলের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করেছে। এই অঞ্চলগুলিতে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন রয়েছে।
অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে সয়াবিন ফসলের উপর নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। পানিতে ডুবে থাকা মাটিতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, যা সয়াবিন গাছের নাইট্রোজেন ফিক্সেশন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। ফলে গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়।
এছাড়া, রাতের তাপমাত্রা ২১-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে সয়াবিন গাছের বৃদ্ধি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেঘলা আবহাওয়া এবং বৃষ্টির কারণে সূর্যালোকের ঘাটতিও ফসলের স্বাস্থ্যের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কৃষকদের অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাও সয়াবিন চাষের ক্ষেত্রফল হ্রাসের একটি বড় কারণ। ডালজাতীয় ফসল এবং তুলার মতো ফসলের বাজারমূল্য এবং সরকারি প্রণোদনা কৃষকদের এই সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, রাজস্থানে সয়াবিন চাষের ক্ষেত্রফল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কমেছে, কারণ কৃষকরা ডালজাতীয় ফসলের দিকে ঝুঁকেছেন। মধ্যপ্রদেশেও সয়াবিন চাষের ক্ষেত্রফল প্রায় ৮ শতাংশ কমেছে।
অতিরিক্ত বৃষ্টির আরেকটি প্রভাব হলো ফসলের গুণগত মানের উপর ক্ষতিকর প্রভাব। বর্ষার সময় অতিরিক্ত আর্দ্রতার কারণে সয়াবিনের শুঁটি ফেটে যাওয়া এবং বীজের ক্ষতি হওয়ার ঘটনা দেখা গেছে। এছাড়া, জলাবদ্ধ মাটিতে ছত্রাকজনিত রোগ যেমন ডায়াপোর্থে পড অ্যান্ড স্টেম ব্লাইট, ফ্রোগআই লিফ স্পট এবং অ্যানথ্রাকনোজের প্রকোপ বেড়েছে, যা বীজের গুণমান এবং তেল ও প্রোটিনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কৃষি বিশেষজ্ঞরা কৃষকদের কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। বপনের সময় মাটির আর্দ্রতা পরীক্ষা করে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা বৃষ্টিমুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। এছাড়া, মাটির কম্প্যাকশন এড়াতে হালকা যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং কভার ক্রপ বা নো-টিল পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে। এই পদক্ষেপগুলি মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা এবং ফসলের ক্ষতি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
সয়াবিন ভারতের তৈলবীজ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৫০ লাখ টন সয়াবিন গৃহীত হয়, যার মধ্যে মহারাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রদেশ প্রধান উৎপাদক। এই বছরের ক্ষেত্রফল হ্রাস এবং ফসলের ক্ষতি সয়াবিন তেল এবং সয়াবিন মিলের উৎপাদন ও সরবরাহের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এটি ভোজ্য তেলের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণ হতে পারে, যা ভারতের মতো দেশে, যেখানে তেল আমদানির উপর নির্ভরতা বেশি, অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আরও ঘন ঘন ঘটতে পারে। তাই, জলবায়ু-সহনশীল সয়াবিন জাতের উন্নয়ন এবং সঠিক জল ব্যবস্থাপনার কৌশল গ্রহণ করা জরুরি।
এছাড়া, কৃষকদের সয়াবিন চাষে উৎসাহিত করতে সরকারি ভর্তুকি এবং বীমা সুবিধা প্রদান করা উচিত। এই পদক্ষেপগুলি সয়াবিন উৎপাদনের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারে এবং কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে।
আন্তর্জাতিক ফোনে খুনের হুমকি, অভিযোগ করলেন চেয়ারম্যান সোমনাথ দে
সামগ্রিকভাবে, এ বছর সয়াবিন চাষের ক্ষেত্রফল হ্রাস এবং ফসলের ক্ষতি ভারতের কৃষি খাতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তবে, সঠিক পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই ক্ষতি কমানো সম্ভব। কৃষক, বিজ্ঞানী এবং সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।