দেশের ডিজিটাল গেমিং ইকোসিস্টেমে বড় পরিবর্তনের পথে এগোলো কেন্দ্র। সোমবার লোকসভায় ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব উপস্থাপন করলেন ‘প্রমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অব অনলাইন গেমিং বিল, ২০২৫’। প্রস্তাবিত এই আইন অনুযায়ী ই-স্পোর্টস (Esports) ও সামাজিক গেমিংকে সরকারি স্বীকৃতি ও প্রণোদনা দেওয়া হবে, তবে অর্থভিত্তিক অনলাইন গেম বা রিয়েল মানি গেমিং (RMG)-এর উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
বিলে বলা হয়েছে, ই-স্পোর্টসকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধ খেলার স্বীকৃতি দেওয়া হবে, একেবারে ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো। এখানে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স নির্ভর করবে তাদের কৌশল, দক্ষতা, চটপট ভাব ও মানসিক তীক্ষ্ণতার উপর— ভাগ্যের উপর নয়।
সরকার ঘোষণা করেছে যে ই-স্পোর্টস প্রতিযোগিতা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও প্রণোদনা প্রকল্প গড়ে তোলা হবে। এর মাধ্যমে ভারতের তরুণ প্রতিভাদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
বিলে ‘সোশ্যাল গেমস’-কে বিশেষভাবে আলাদা করা হয়েছে। এগুলো এমন গেম যেখানে অর্থের বিনিময়ে বাজি ধরা হয় না। বিনোদন, শিক্ষণ বা দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তৈরি গেমগুলিকে উৎসাহিত করা হবে।
ডেভেলপাররা সরকারি নিবন্ধনের আওতায় আসতে পারবেন এবং স্কুল-কলেজগুলিকে সামাজিক গেমকে অতিরিক্ত পাঠক্রম বা সহশিক্ষার অংশ হিসেবে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অর্থভিত্তিক অনলাইন গেম বা বেটিং গেমস-এর উপর সরকারের সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা।
কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা এই ধরনের গেম চালাতে, বিজ্ঞাপন দিতে বা প্রচার করতে পারবে না।
ব্যাংক ও পেমেন্ট গেটওয়ে কোম্পানিগুলিকে এই প্ল্যাটফর্মে লেনদেন করার অনুমতি দেওয়া হবে না।
অর্থভিত্তিক গেম চালালে সর্বোচ্চ ৩ বছর জেল বা ১ কোটি টাকা জরিমানা হতে পারে।
বিজ্ঞাপন বা প্রচার করলে ২ বছর জেল অথবা ৫০ লক্ষ টাকা জরিমানা।
অর্থ লেনদেনে সহায়তা করলে একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।
পুনরাবৃত্তি ঘটলে আরও কঠোর শাস্তি কার্যকর হবে।
কোম্পানি জড়িত থাকলে সংগঠন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করা হবে।
এছাড়া এই অপরাধকে অ-জামিনযোগ্য (Non-Bailable) হিসাবে গণ্য করা হবে।
বিলে একটি স্বাধীন অনলাইন গেমিং অথরিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সংস্থা গেমের শ্রেণিবিভাগ করবে— কোনটি ই-স্পোর্টস, কোনটি সামাজিক গেম, আর কোনটি অবৈধ অর্থভিত্তিক গেম।
অভিযোগ শোনার পাশাপাশি নিবন্ধন সংরক্ষণ ও আইন প্রয়োগের ক্ষমতাও থাকবে কর্তৃপক্ষের হাতে। কর্মকর্তারা ওয়ারেন্ট ছাড়াই তল্লাশি, বাজেয়াপ্ত বা গ্রেফতার করতে পারবেন। সরকারও প্রয়োজনে ওয়েবসাইট, অ্যাপ বা প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করে দিতে পারবে।
সরকার অনলাইন গেমকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছে—
1. ভালো গেম (ই-স্পোর্টস ও সামাজিক গেমিং)
2. নিষিদ্ধ গেম (অনলাইন মানি গেম)
এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জুয়াভিত্তিক গেমকে দমন করে, শিক্ষামূলক ও দক্ষতা বাড়ানো গেমকে উৎসাহ দেওয়াই সরকারের লক্ষ্য। আইন কার্যকর হলে বিদেশি প্ল্যাটফর্মও ভারতীয় ব্যবহারকারীর জন্য অর্থভিত্তিক গেম চালাতে পারবে না।
ভারতের গেমিং ইন্ডাস্ট্রি এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে।
বিশাল গোঁদাল, কো-ফাউন্ডার, nCore Games:
“সরকার যে রিয়েল মানি গেমিং নিষিদ্ধ করেছে এবং শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এনেছে, তা আমরা সাধুবাদ জানাই। এটি তরুণ প্রজন্মকে আসক্তি ও ঋণের ফাঁদ থেকে বাঁচাবে এবং ভারতের মৌলিক IP ও সৃজনশীল গেমিংকে এগিয়ে নেবে।”
হরিশ চেঙ্গাইয়া, সিইও, Outlier Games:
“দীর্ঘদিন ধরে আমরা চাইছিলাম আমাদের ব্যবসাকে আলাদা করে ‘ভিডিও গেমস ইন্ডাস্ট্রি’ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। এই বিল সেই দাবি পূরণ করেছে। তবে ‘অনলাইন সোশ্যাল গেমস’ শব্দটি বিশ্বে বহুল প্রচলিত নয়, তাই টার্মিনোলজি পরিষ্কার করা দরকার।”
দীপক আলি, সিইও, Dot9Games:
“এই আইন আমাদেরকে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রতিফলিত করে এমন নতুন গেম তৈরি করতে উৎসাহিত করবে। যেমন ভারতীয় সিনেমা সাংস্কৃতিক সফট পাওয়ার, তেমনই ভারতীয় গেমও বিশ্বমঞ্চে বড় প্রভাব ফেলতে পারবে।”
সুমিত বাথেজা, সিইও, Ginger Games:
“আমরা এখন আর বোঝাতে সময় নষ্ট করব না যে আমরা জুয়া সংস্থা নই। বরং মনোযোগ দেব মনিটাইজেশন, রিটেনশন ও বিশ্বমানের IP তৈরিতে।”
মানসুর ‘নাবু’ আহমেদ, সিইও, Aftermath Ventures:
“ই-স্পোর্টসকে বৈধতা দেওয়াটা বড় প্রাপ্তি। এতে খেলোয়াড়রা শুধু পারফরম্যান্সে মনোযোগ দিতে পারবে এবং ভারত থেকে কোটি কোটি নতুন গেমার তৈরি হবে।”
অক্ষত রাতি, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, NODWIN Gaming:
“সরকারের এই উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে ই-স্পোর্টস, অনলাইন গেমিং, সামাজিক গেমিং ও মানি গেমিংয়ের পার্থক্য স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়া জরুরি।”
অনিমেষ ‘থাগ’ আগরওয়াল, সিইও, S8UL:
“এই বিল ভারতীয় ই-স্পোর্টসের জন্য ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দক্ষতা নির্ভর প্রতিযোগিতা ও বাজি নির্ভর গেমের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা হয়েছে। এর ফলে আমাদের ইকোসিস্টেম সুরক্ষিত থাকবে এবং সংগঠিত বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে।”
‘প্রমোশন অ্যান্ড রেগুলেশন অব অনলাইন গেমিং বিল, ২০২৫’ ভারতীয় গেমিং ইন্ডাস্ট্রির জন্য এক মোড় ঘোরানো আইন হতে চলেছে। একদিকে যেমন বাজি ও জুয়া নির্ভর গেমের উপর কড়া শাস্তি আরোপ করা হচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে ই-স্পোর্টস ও সামাজিক গেমিংয়ের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন হচ্ছে। সরকার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে— শিক্ষা, বিনোদন ও দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক গেমকে প্রণোদনা দেওয়া হবে, কিন্তু অর্থভিত্তিক গেমের কোনও স্থান থাকবে না ভারতের ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে।