ভারতীয় সরকার (Modi Government) যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে আরও একটি বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। গতকাল, ১৯ আগস্ট, মোদী সরকার ৬২,০০০ কোটি টাকার একটি দুর্দান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যার মাধ্যমে ৯৭টি এলসিএ (লাইট কমব্যাট এয়ারক্রাফট) মার্ক ১এ লড়াই জাহাজ কেনা হবে। এই চুক্তিটি হিন্দুস্তান এয়ারনটিকস লিমিটেড (এইচএএল) দ্বারা পরিচালিত হবে এবং এটি ভারতীয় বিমান বাহিনীর পুরানো মিগ-২১ বিমান ফ্লিটের পরিবর্তে ব্যবহৃত হবে। এই পদক্ষেপটি শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর শক্তিশালীকরণের জন্য নয়, বরং “মেক ইন ইন্ডিয়া” উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশীয় প্রযুক্তি ও শিল্পক্ষেত্রের উন্নতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যও রয়েছে। তবে, এই মহাকাশীয় বিনিয়োগের পেছনে কতটা কার্যকর ফলাফল আসবে, তা নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশ্ন উঠছে।
চুক্তির বড় বৈশিষ্ট্য
এই ৯৭টি এলসিএ মার্ক ১এ বিমানের চুক্তি ২০২৩ নভেম্বরে প্রথম অনুমোদন পেয়েছিল, তবে গতকাল এটি আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালে ৮৩টি এই ধরনের বিমানের জন্য ৪৮,০০০ কোটি টাকার চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল। এই নতুন চুক্তি সেই ধারাবাহিকতার একটি অংশ। এই বিমানগুলোর উৎপাদনে ৬৫% এর বেশি দেশীয় উপাদান ব্যবহৃত হবে, যা ভারতের রক্ষা উৎপাদন ক্ষেত্রে স্বাবলম্বনের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এইচএএল-এর নাশিক কারখানায় এই বিমান উৎপাদনের কাজ শুরু হয়ে গেছে, এবং এটি ছোট ও মাঝারি স্কেলের উদ্যোগগুলোর জন্যও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
সামরিক শক্তির উন্নতি ও চ্যালেঞ্জ
ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএএফ) দীর্ঘদিন ধরে তার পুরানো মিগ-২১ বিমান ফ্লিট প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা করছে। মিগ-২১ বিমানগুলো প্রায় ৫০ বছরের পুরানো এবং বারবার দুর্ঘটনার কারণে এদের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এলসিএ তেজাস মার্ক ১এ বিমানগুলো আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সজ্জিত এবং এটি শত্রুর সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষে ভারতের সুনির্দিষ্ট সুবিধা প্রদান করতে পারে। তবে, এই বিমানের ইঞ্জিন নির্ভরতা আমেরিকার উপর রয়েছে, যা ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তেজাস বিমানে ব্যবহৃত জিই এফ৪০৪ ইঞ্জিনের সরবরাহ বিলম্বের কারণে পূর্বে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবং দেশীয় কাভেরি ইঞ্জিনের উন্নয়নে এখনও বিলম্ব রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি এইচএএল তার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে না পারে, তবে ৯৭টি বিমানের বিতরণে বিলম্ব হতে পারে। ২০২৪ নভেম্বরে প্রথম বিতরণের লক্ষ্য ছিল, তবে বর্তমানে এটি সন্দেহজনক। এই পরিস্থিতিতে, সরকারকে বৈদেশিক অংশীদারদের সঙ্গে আরও দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, এবং একই সঙ্গে দেশীয় ইঞ্জিন উৎপাদনের উপর জোর দিতে হবে।
“মেক ইন ইন্ডিয়া” এর উত্থান
এই চুক্তিটি “মেক ইন ইন্ডিয়া” উদ্যোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ৬৫% দেশীয় উপাদানের ব্যবহার এবং এইচএএল-এর নেতৃত্বে উৎপাদন ভারতের রক্ষা শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তুলে ধরার একটি প্রয়াস। এইচএএল-এর নাশিক কারখানা এবং অন্যান্য ছোট শিল্পক্ষেত্রের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টা এই উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করবে। তবে, রক্ষা উৎপাদন ক্ষেত্রে ভারত এখনও পূর্ণ স্বাবলম্বন অর্জন করতে পারেনি। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিআইপিআরআই) এর ২০২৩ রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানি কর্মী দেশ (২০২০-২৪ এর ৮.৩% অংশ), যা দেশীয় উৎপাদনের দুর্বলতা প্রকাশ করে।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ও সমালোচনা
তেজাস মার্ক ১এ বিমান ২০২৪-এর প্রথম পর্বে “তরঙ্গ শক্তি ২০২৪” অভ্যাসে অংশ নিয়েছে, যা এর কার্যক্ষমতার একটি প্রমাণ। তবে, কিছু সমালোচক মনে করেন, যখন চীন ৬ষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান তৈরি করছে, তখন ভারতের এই ধাপটি যথেষ্ট নাও হতে পারে। তাছাড়া, এইচএএল-এর উৎপাদন ক্ষমতা এবং ইঞ্জিন সরবরাহের বিলম্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী মজা করেও বলছেন, “২০৫০ সালের আগে এই বিমানগুলো পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ!”
এইচএএল-এর শেয়ার মূল্যে এই খবরের পর উত্থান দেখা গেছে, যা বাজারের আশাবাদ প্রকাশ করে। তবে, সরকারের উপর চাপ রয়েছে যে, এই বিনিয়োগ সত্যিই ভারতীয় সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়াতে পারে কিনা। যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং দেশীয় শিল্পের উন্নতি একসঙ্গে সামঞ্জস্য করতে হলে সরকারকে আরও দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৬২,০০০ কোটি টাকার এই চুক্তি ভারতের সামরিক শক্তি ও আর্থ-অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, এর সফলতা নির্ভর করবে এইচএএল-এর উৎপাদন ক্ষমতা, ইঞ্জিন উন্নয়ন এবং বৈদেশিক সহযোগিতার উপর। ভারত যদি এই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করতে পারে, তবে এটি দেশের রক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা হবে।