ভারতের টেলিকম শিল্পে রিলায়েন্স জিও-র সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত, অর্থাৎ তাদের এন্ট্রি-লেভেল ২৮ দিনের প্রিপেইড প্ল্যান বন্ধ (Jio Rs 249 Plan Discontinued) করায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই পদক্ষেপ প্রতিযোগী সংস্থা এয়ারটেল এবং ভোডাফোন আইডিয়া (ভি)-এর উপর চাপ সৃষ্টি করছে, যারা হয় এই পথ অনুসরণ করবে অথবা তাদের বর্তমান মূল্য কাঠামো বজায় রাখবে। এই নিবন্ধে আমরা জিও-র ২৪৯ টাকার প্ল্যান বন্ধের প্রভাব, এয়ারটেল, ভি এবং বিএসএনএল-এর তুলনামূলক প্ল্যান এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
জিও-র ২৪৯ টাকার প্ল্যান বন্ধ: ব্যবহারকারীদের উপর প্রভাব
১৮ আগস্ট, ২০২৫ থেকে, জিও তার ২৪৯ টাকার প্ল্যান বন্ধ করেছে, যা ২৮ দিনের জন্য প্রতিদিন ১ জিবি ডেটা প্রদান করত। এটি ছিল জিও-র গ্রাহকদের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী এবং জনপ্রিয় প্ল্যানগুলির মধ্যে একটি। এখন জিও-র ওয়েবসাইটে উপলব্ধ সবচেয়ে সাশ্রয়ী প্ল্যানটি হল ২৯৯ টাকার, যা ২৮ দিনের জন্য প্রতিদিন ১.৫ জিবি ডেটা প্রদান করে। এর ফলে জিও গ্রাহকদের মাসিক খরচ ৫০ টাকা বেড়ে গেছে।
এই পদক্ষেপের পেছনে জিও-র লক্ষ্য হল গড় রাজস্ব প্রতি গ্রাহক (ARPU) বৃদ্ধি করা, যা টেলিকম শিল্পের লাভজনকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ মেট্রিক। কম ডেটা এবং কম খরচের প্ল্যান বন্ধ করে জিও গ্রাহকদের উচ্চ-মূল্যের প্ল্যানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, যারা বেশি ডেটা বা ভালো মূল্য চান, তারা এখন ২৮ দিনের ২ জিবি/দিন প্ল্যানটি বেছে নিতে পারেন, যার মূল্য ৩৪৯ টাকা। এইভাবে জিও তার ট্যারিফ কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করছে এবং গ্রাহকদের উচ্চ রাজস্ব উৎপাদনকারী প্ল্যানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
এয়ারটেল এবং ভোডাফোন আইডিয়া: প্ল্যান তুলনা
জিও-র এই পদক্ষেপের ফলে এয়ারটেল এবং ভোডাফোন আইডিয়ার উপর প্রভাব পড়তে পারে। ঐতিহাসিকভাবে, যখন একটি প্রধান টেলিকম সংস্থা তার ট্যারিফ কাঠামো পরিবর্তন করে, তখন প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য একই পথ অনুসরণ করে, মূল্য যুদ্ধ এড়িয়ে। এয়ারটেলের ভাইস চেয়ারম্যান গোপাল বিট্টাল সম্প্রতি “ট্যারিফ রিপেয়ার” এর প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন, যাতে পুঁজির উপর টেকসই রিটার্ন নিশ্চিত করা যায়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে এয়ারটেলও মূল্য বৃদ্ধির পথে হাঁটতে পারে।
বর্তমানে, এয়ারটেল এবং ভোডাফোন আইডিয়া উভয়ই ২৮ দিনের জন্য ১ জিবি/দিন প্ল্যান ২৯৯ টাকায় অফার করছে, যা জিও-র বন্ধ হওয়া ২৪৯ টাকার প্ল্যানের তুলনায় কিছুটা ব্যয়বহুল ছিল, কিন্তু এখন জিও-র নতুন মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের ১.৫ জিবি/দিন প্ল্যানের মূল্য ৩৪৯ টাকা এবং ২ জিবি/দিন প্ল্যানের মূল্য যথাক্রমে ৪০৮ টাকা (ভি) এবং ৩৯৯ টাকা (এয়ারটেল)। এই মূল্যের সামঞ্জস্য টেলিকম শিল্পে ট্যারিফ একীকরণের ইঙ্গিত দেয়।
বিএসএনএল: সাশ্রয়ী বিকল্প
বিপরীতে, ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (বিএসএনএল) মূল্য নির্ধারণে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। বিএসএনএল ৩০ দিনের জন্য ১.৫ জিবি/দিন প্ল্যান মাত্র ১৪১ টাকায় এবং ২.২ জিবি/দিন প্ল্যান ১৪৮ টাকায় অফার করে। এছাড়াও, বিএসএনএল-এর ৩০ দিনের ২ জিবি/দিন প্ল্যানের মূল্য ১৯৯ টাকা, যা জিও, এয়ারটেল এবং ভি-এর তুলনায় অনেক কম।
তবে, বিএসএনএল-এর সীমিত ৪জি কভারেজ এবং নেটওয়ার্ক গুণমানের সমস্যা এটিকে শহুরে এবং আধা-শহুরে গ্রাহকদের কাছে প্রধান বিকল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা থেকে বঞ্চিত করছে। বিএসএনএল বর্তমানে দেশব্যাপী ৪জি নেটওয়ার্ক রোলআউট করছে, যা ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, জিও এবং এয়ারটেলের ৫জি নেটওয়ার্কের তুলনায় বিএসএনএল-এর ৪জি পরিষেবা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট
পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে কৃষক এবং ছোট ব্যবসায়ীরা সাশ্রয়ী টেলিকম পরিষেবার উপর নির্ভর করে, জিও-র এই মূল্য বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের অনেকে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা (PMFBY) বা অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের তথ্য পেতে এবং ব্যবসায়িক যোগাযোগের জন্য সাশ্রয়ী ডেটা প্ল্যানের উপর নির্ভর করে। জিও-র ২৪৯ টাকার প্ল্যান বন্ধ হওয়ায় এই গ্রাহকদের এখন বেশি খরচ করতে হবে, যা তাদের মাসিক বাজেটে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, বিএসএনএল-এর সাশ্রয়ী প্ল্যানগুলি গ্রামীণ ব্যবহারকারীদের জন্য একটি বিকল্প হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বিএসএনএল-এর ১৪১ টাকার ৩০ দিনের প্ল্যান কৃষকদের জন্য ডিজিটাল সংযোগ বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। তবে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় বিএসএনএল-এর নেটওয়ার্ক কভারেজ উন্নত করা প্রয়োজন, যাতে এই প্ল্যানগুলি সত্যিই কার্যকর হয়।
অন্যদিকে, কলকাতার মতো শহুরে এলাকায়, যেখানে ৫জি নেটওয়ার্কের চাহিদা বাড়ছে, জিও এবং এয়ারটেলের ৫জি-সক্ষম প্ল্যানগুলি (২ জিবি/দিন বা তার বেশি) বেশি আকর্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ, জিও-র ৩৪৯ টাকার প্ল্যান এবং এয়ারটেলের ৩৯৯ টাকার প্ল্যানে আনলিমিটেড ৫জি ডেটা পাওয়া যায়, যা টেক স্টার্টআপ এবং তরুণ পেশাদারদের জন্য উপযোগী।
টেলিকম শিল্পে ভবিষ্যৎ প্রবণতা
জিও-র এই পদক্ষেপ টেলিকম শিল্পে আরও ট্যারিফ বৃদ্ধির সম্ভাবনা ইঙ্গিত করে। আইসিআরএ-র বিশ্লেষক অঙ্কিত জৈনের মতে, ২০২৫ সালের অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ২০২৬-এর মধ্যে আরেক দফা ট্যারিফ বৃদ্ধি হতে পারে, যদিও এটি ২০২৪ সালের তুলনায় কম (১৫-২০%) হবে। এই বৃদ্ধি গ্রাহকদের জন্য খরচ বাড়ালেও, টেলিকম সংস্থাগুলির ৫জি বিনিয়োগ এবং নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয়।
সমাধানের পথ
- গ্রাহক সচেতনতা: পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এবং শহুরে গ্রাহকদের জন্য টেলিকম সংস্থাগুলির প্ল্যান তুলনা করার সুবিধা বাড়ানো উচিত। সরকারি প্রকল্প যেমন ডিজিটাল ইন্ডিয়ার মাধ্যমে এই তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
- বিএসএনএল-এর নেটওয়ার্ক উন্নতি: বিএসএনএল-এর ৪জি রোলআউট ত্বরান্বিত করা এবং পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় নেটওয়ার্ক কভারেজ বাড়ানো প্রয়োজন।
- কাস্টমাইজড প্ল্যান: কৃষক এবং ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য কম খরচে ভয়েস এবং এসএমএস প্ল্যান চালু করা যেতে পারে, যেমন টিআরএআই-এর সাম্প্রতিক নির্দেশিকা অনুযায়ী।
জিও-র ২৪৯ টাকার প্ল্যান বন্ধ করা এবং ন্যূনতম প্ল্যানের মূল্য ২৯৯ টাকায় উন্নীত করা ভারতের টেলিকম শিল্পে একটি বড় পরিবর্তন। এয়ারটেল এবং ভোডাফোন আইডিয়া বর্তমানে জিও-র নতুন মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্ল্যান অফার করছে, তবে বিএসএনএল তার সাশ্রয়ী প্ল্যানের মাধ্যমে একটি বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য, এই মূল্য বৃদ্ধি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। তবে, বিএসএনএল-এর নেটওয়ার্ক উন্নতি এবং সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে গ্রাহকদের জন্য সাশ্রয়ী এবং নির্ভরযোগ্য টেলিকম পরিষেবা নিশ্চিত করা সম্ভব।