কেন চলতিবর্ষে কলকাতার কল সেন্টারে নিয়োগ কমছে? এইচআর ম্যানেজারদের মতামত

কলকাতা ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত, দীর্ঘদিন ধরে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) এবং কল সেন্টার শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তবে, ২০২৫ সালে কলকাতার কল সেন্টার…

Why Kolkata Call Centers Are Hiring Less in 2025: HR Managers Reveal Key Reasons

কলকাতা ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত, দীর্ঘদিন ধরে বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) এবং কল সেন্টার শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। তবে, ২০২৫ সালে কলকাতার কল সেন্টার (Kolkata Call Centers) শিল্পে নিয়োগে একটি লক্ষণীয় মন্দা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এইচআর ম্যানেজারদের সঙ্গে কথোপকথন এবং শিল্প বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই মন্দার পেছনের কারণগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। এই নিবন্ধে আমরা কলকাতার কল সেন্টারে নিয়োগ কমার কারণ, এর প্রভাব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।

কল সেন্টারে নিয়োগে মন্দার কারণ
কলকাতার কল সেন্টার শিল্পে নিয়োগে মন্দার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যা এইচআর ম্যানেজার এবং শিল্প বিশেষজ্ঞরা তুলে ধরেছেন:

   

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং অটোমেশন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং চ্যাটবটের মতো প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার কল সেন্টারে মানব সম্পদের উপর নির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে। ২০২৫ সালে, অনেক কল সেন্টার AI-চালিত গ্রাহক পরিষেবা সমাধান গ্রহণ করছে, যা সাধারণ প্রশ্ন এবং টেকনিক্যাল সাপোর্টের জন্য মানুষের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করছে। এইচআর ম্যানেজাররা জানিয়েছেন, “AI এবং অটোমেশনের কারণে আমাদের এন্ট্রি-লেভেল পজিশনের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।”

অন্যান্য শিল্পে প্রতিযোগিতা: কলকাতার অর্থনীতি বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠছে, এবং আইটি, খুচরা, শিক্ষা, এবং আতিথেয়তা শিল্পে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এই শিল্পগুলি কল সেন্টারের তুলনায় উচ্চ বেতন, ভালো কাজের পরিবেশ, এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্যারিয়ারের সম্ভাবনা প্রদান করছে। ফলে, ইংরেজি-ভাষী স্নাতকরা, যারা একসময় কল সেন্টারে যোগ দিতেন, এখন অন্যান্য ক্ষেত্রে চাকরি খুঁজছেন। একজন এইচআর ম্যানেজার বলেন, “আমরা লক্ষ্য করছি, তরুণ প্রজন্ম কল সেন্টারের কাজকে কম আকর্ষণীয় মনে করছে, কারণ এটি দীর্ঘ সময় কম্পিউটারের সামনে কাটানো এবং ক্যারিয়ারের অগ্রগতির সীমিত সুযোগ প্রদান করে।”

উচ্চ অ্যাট্রিশন রেট: কল সেন্টার শিল্পে অ্যাট্রিশন (কর্মী প্রত্যাহার) হার সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের কল সেন্টারে অ্যাট্রিশন রেট ৩০-৪০% পর্যন্ত হতে পারে। কলকাতায়, রাত্রিকালীন শিফট, উচ্চ চাপ, এবং কম ক্যারিয়ার বৃদ্ধির সম্ভাবনা কর্মীদের চাকরি ছাড়তে উৎসাহিত করছে। এইচআর ম্যানেজাররা জানিয়েছেন, “অ্যাট্রিশনের কারণে আমাদের ক্রমাগত নিয়োগ করতে হয়, কিন্তু ২০২৫ সালে আমরা আরও নির্বাচনী হচ্ছি এবং শুধুমাত্র দক্ষ এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রার্থীদের নিয়োগ করছি।”

অর্থনৈতিক ও নীতিগত পরিবর্তন: কলকাতার কল সেন্টার শিল্প বিদেশী ক্লায়েন্টদের উপর নির্ভরশীল। পশ্চিমা দেশগুলিতে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বা আউটসোর্সিং সীমিত করার নীতি গ্রহণ করা হলে এটি ভারতের কল সেন্টার শিল্পে প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিপাইন এবং মেক্সিকোর মতো দেশগুলি তাদের সরকারী নীতি এবং কম খরচের কারণে কল সেন্টার আউটসোর্সিংয়ের জন্য প্রতিযোগিতা বাড়াচ্ছে। এইচআর ম্যানেজাররা বলছেন, “আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা এবং বিদেশী নীতির পরিবর্তন আমাদের ব্যবসার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে, যা নিয়োগে প্রভাব ফেলছে।”

Advertisements

দক্ষতার ঘাটতি: কল সেন্টারের কাজের জন্য শুধু ইংরেজি দক্ষতাই নয়, গ্রাহক পরিষেবা, টেকনিক্যাল সাপোর্ট, এবং ক্রমবর্ধমান ভাষাগত বৈচিত্র্যের (যেমন ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ) দক্ষতার প্রয়োজন। কলকাতায় এই দক্ষতার অভাব নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করছে। একজন এইচআর ম্যানেজার উল্লেখ করেছেন, “আমরা এখন শুধু ইংরেজি-ভাষী প্রার্থী নয়, বহুভাষিক এবং প্রযুক্তি-দক্ষ প্রার্থীদের খুঁজছি, যা পাওয়া কঠিন।”

পশ্চিমবঙ্গে কল সেন্টার শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি
২০২৫ সালে কলকাতায় কল সেন্টার জবের চাহিদা কমলেও, শিল্পটি সম্পূর্ণভাবে স্থবির নয়। Indeed.com-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্টে কলকাতায় ১,৬৩০টি কল সেন্টার জব উপলব্ধ ছিল, যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম। তবে, WorkIndia এবং Shine.com-এর মতো প্ল্যাটফর্মে দেখা যায়, টেলিকলার, কাস্টমার সাপোর্ট এক্সিকিউটিভ এবং টেকনিক্যাল সাপোর্ট রোলগুলির জন্য এখনও চাহিদা রয়েছে। এই পদগুলির বেশিরভাগই সল্টলেক, নিউ টাউন, এবং রাজারহাটের মতো এলাকায় কেন্দ্রীভূত।

তবে, Fusion CX-এর মতো শীর্ষস্থানীয় বিপিও সংস্থাগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালে ভারতের বিপিও শিল্পে ৭% চাকরি বৃদ্ধি হলেও, এই বৃদ্ধি মূলত গ্রামীণ এবং টিয়ার-২ শহরগুলিতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। কলকাতার মতো মেট্রো শহরগুলিতে নিয়োগের গতি কমে গেছে, কারণ এই শহরগুলিতে অপারেশনাল খরচ বেশি এবং প্রতিযোগিতা তীব্র।

সমাধানের পথ
কলকাতার কল সেন্টার শিল্পে নিয়োগ বাড়াতে এবং এই মন্দা কাটিয়ে উঠতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

  • দক্ষতা উন্নয়ন: কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্কিত কথা বিবেচনা করে, গ্রামীণ যুবকদের জন্য ইংরেজি ভাষা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, এবং গ্রাহক পরিষেবা প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। এটি তাদের কল সেন্টারে চাকরির জন্য উপযুক্ত করে তুলবে।
  • কর্মী ধরে রাখার কৌশল: গেমিফিকেশন, কর্মচারী সুস্থতা প্রোগ্রাম, এবং ক্যারিয়ার উন্নয়নের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে অ্যাট্রিশন রেট কমানো যেতে পারে। Fusion CX-এর মতো সংস্থাগুলি ইতিমধ্যে এই কৌশলগুলি ব্যবহার করে ৪৮% বেশি কর্মচারী ব্যস্ততা অর্জন করেছে।
  • বহুভাষিক পরিষেবা: কল সেন্টারগুলি ফরাসি, জার্মান, এবং স্প্যানিশের মতো ভাষায় পরিষেবা প্রদানের দিকে মনোনিবেশ করলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। এটি নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
  • সরকারী নীতি: ডিজিটাল ইন্ডিয়া এবং স্পেশাল ইকোনমিক জোন (SEZ) সম্প্রসারণের মতো সরকারী উদ্যোগগুলি কলকাতায় বিপিও শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।

কলকাতার কল সেন্টার শিল্পে ২০২৫ সালে নিয়োগে মন্দা একটি জটিল সমস্যা, যা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, প্রতিযোগিতামূলক শিল্প, উচ্চ অ্যাট্রিশন, এবং আন্তর্জাতিক নীতির সমন্বয়ে সৃষ্ট। এইচআর ম্যানেজারদের মতে, এই শিল্পে টিকে থাকতে হলে দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মী ধরে রাখার কৌশল, এবং বহুভাষিক পরিষেবার উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য এই মন্দা অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করলেও, সঠিক প্রশিক্ষণ এবং সরকারী সহায়তার মাধ্যমে এই শিল্প পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।