ভারতের কৃষি খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, যা প্রায় ১৮% জিডিপিতে অবদান রাখে এবং দেশের প্রায় অর্ধেক শ্রমশক্তির জীবিকা নির্বাহ করে। তবে, সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, ভারতের প্রায় ৩০% ভূমি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে, যা কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে কৃষি অর্থনীতির একটি প্রধান অংশ, সেখানেও মাটির ক্ষয় একটি বড় সমস্যা। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব কীভাবে জৈব চাষের (Organic Farming) মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ এই সংকট মোকাবিলা করতে পারে এবং টেকসই কৃষির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
মাটির ক্ষয়: পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট
ভারতের মাটির স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যে রয়েছে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত সেচ, মাটির ক্ষয়, এবং জৈব পদার্থের হ্রাস। পশ্চিমবঙ্গে, যেখানে ধান, পাট, এবং শাকসবজির মতো ফসলের উপর নির্ভরশীলতা বেশি, সেখানে মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। অতিরিক্ত বৃষ্টি এবং বন্যার কারণে মাটির ক্ষয়, পুষ্টির ক্ষতি এবং জলাবদ্ধতা সমস্যা আরও জটিল করে তুলেছে। এই অঞ্চলের কৃষকরা প্রায়শই উচ্চ ফলনের জন্য রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের উপর নির্ভর করেন, যা দীর্ঘমেয়াদে মাটির জৈব পদার্থ হ্রাস করে এবং পরিবেশের ক্ষতি করে।
পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে ভেজা জমিতে চাষ (wetland farming) প্রচলিত, সেখানে জলাবদ্ধতা এবং মাটির পুষ্টি হ্রাস একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে, জৈব চাষ এই সমস্যার সমাধান হিসেবে কাজ করতে পারে। জৈব চাষ মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার, জল ধরে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতি প্রচারে সহায়ক।
জৈব চাষ: একটি টেকসই সমাধান
জৈব চাষ হল এমন একটি পদ্ধতি যেখানে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের পরিবর্তে প্রাকৃতিক সার (যেমন কম্পোস্ট, গোবর) এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতি মাটির জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ায়, মাটির গঠন উন্নত করে এবং জল ধরে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পশ্চিমবঙ্গে জৈব চাষের মাধ্যমে মাটির ক্ষয় রোধ করার জন্য নিম্নলিখিত কৌশলগুলি গ্রহণ করা যেতে পারে:
ফসল বৈচিত্র্যকরণ এবং ফসল ঘূর্ণন
একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষ করলে মাটির পুষ্টি হ্রাস পায়। ফসল ঘূর্ণন এবং মিশ্র চাষ (mixed farming) মাটির উর্বরতা ধরে রাখতে সহায়ক। উদাহরণস্বরূপ, ধানের পরে ডাল বা তৈলবীজ ফসল চাষ করা মাটির নাইট্রোজেন স্তর পুনরুদ্ধার করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা ধানের পাশাপাশি পাট, শাকসবজি, এবং ডাল জাতীয় ফসলের মাধ্যমে এই কৌশল প্রয়োগ করতে পারেন।
জৈব সার এবং কম্পোস্ট ব্যবহার
গোবর, কম্পোস্ট, এবং ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করে মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধি করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় গবাদি পশু থেকে প্রাপ্ত গোবর সহজলভ্য। এই প্রাকৃতিক সার মাটির পুষ্টি সরবরাহ করে এবং রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমায়।
কভার ক্রপিং এবং মালচিং
কভার ফসল (যেমন মটরশুটি, মসুর) এবং মালচিং মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং আর্দ্রতা ধরে রাখে। এই পদ্ধতি পশ্চিমবঙ্গের বন্যাপ্রবণ এলাকায় বিশেষভাবে কার্যকর, যেখানে অতিরিক্ত বৃষ্টি মাটির পুষ্টি ধুয়ে নিয়ে যায়।
অ্যাগ্রোফরেস্ট্রি এবং টেকসই পদ্ধতি
অ্যাগ্রোফরেস্ট্রি, যেখানে ফসলের সাথে গাছ চাষ করা হয়, মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক। পশ্চিমবঙ্গে আম, লিচু, এবং কলা গাছের সাথে ফসল চাষ এই পদ্ধতির একটি উদাহরণ হতে পারে।
ড্রিপ সেচ এবং জল ব্যবস্থাপনা
অতিরিক্ত সেচ মাটির ক্ষয় এবং পুষ্টি হ্রাসের একটি প্রধান কারণ। ড্রিপ সেচ পদ্ধতি জলের ব্যবহার কমায় এবং ফসলের শিকড়ে সরাসরি জল সরবরাহ করে। এই পদ্ধতি পশ্চিমবঙ্গের শুষ্ক অঞ্চলে বিশেষভাবে উপযোগী।
পশ্চিমবঙ্গে জৈব চাষের সম্ভাবনা
পশ্চিমবঙ্গে জৈব চাষের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। রাজ্যের কৃষকরা ইতিমধ্যে ধান, শাকসবজি, এবং পাটের মতো ফসলের জন্য জৈব পদ্ধতি গ্রহণ করছেন। সরকারি উদ্যোগ যেমন জাতীয় কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প (RKVY) এবং পারম্পরিক কৃষি উন্নয়ন পরিকল্পনা (PKVY) জৈব চাষকে উৎসাহিত করছে। এই প্রকল্পগুলি কৃষকদের প্রশিক্ষণ, জৈব সার সরবরাহ, এবং বাজার সংযোগ প্রদান করে।
উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গের পোলবায় ২০১৪-১৫ সালে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, সিস্টেম অফ রাইস ইনটেনসিফিকেশন (SRI) এবং জৈব চাষের মাধ্যমে ধানের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মাটির স্বাস্থ্য উন্নত হয়েছে। এছাড়া, জৈব শাকসবজির চাহিদা শহরাঞ্চলে বাড়ছে, যা কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক বাজার তৈরি করছে। কলকাতার মতো শহরে জৈব পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে কৃষকরা উচ্চ মূল্যে তাদের পণ্য বিক্রি করতে পারছেন।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
জৈব চাষে রূপান্তরের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন প্রাথমিক বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণের অভাব, এবং বাজার অ্যাক্সেস। তবে, এই সমস্যাগুলি মোকাবিলার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
সরকারি সহায়তা এবং ভর্তুকি: জৈব চাষের জন্য সরকারি ভর্তুকি এবং ঋণ সুবিধা কৃষকদের বিনিয়োগে সহায়তা করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জাতীয় উদ্যান বিভাগ (NHB) জৈব চাষের জন্য ৫০-৮০% ভর্তুকি প্রদান করে।
কৃষক প্রশিক্ষণ: জৈব চাষের কৌশল, যেমন কম্পোস্ট তৈরি এবং জৈব কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, শেখানোর জন্য স্থানীয় কৃষি কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।
বাজার সংযোগ: জৈব পণ্যের জন্য স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অ্যাক্সেস বাড়ানোর জন্য ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম এবং কৃষক সমবায় সমিতির সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা যেতে পারে।
প্রযুক্তির ব্যবহার: ফার্মোনটের মতো স্যাটেলাইট-ভিত্তিক প্রযুক্তি কৃষকদের মাটির স্বাস্থ্য এবং ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণে সহায়তা করতে পারে। এই প্রযুক্তি জৈব চাষের দক্ষতা বাড়াতে পারে।
ভারতের ৩০% ভূমির ক্ষয় একটি গুরুতর সংকট, এবং পশ্চিমবঙ্গ এই সমস্যার মোকাবিলায় জৈব চাষের মাধ্যমে একটি টেকসই পথ বেছে নিতে পারে। ফসল বৈচিত্র্যকরণ, জৈব সার ব্যবহার, কভার ক্রপিং, এবং অ্যাগ্রোফরেস্ট্রির মতো পদ্ধতি মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার এবং কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। সরকারি সহায়তা, কৃষক প্রশিক্ষণ, এবং প্রযুক্তির ব্যবহার এই রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা জৈব চাষের মাধ্যমে শুধু মাটির ক্ষয় রোধ করতে পারবে না, বরং একটি টেকসই এবং লাভজনক কৃষি ব্যবস্থাও গড়ে তুলতে পারবে।